রবিবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » ফিচার » ১২ নভেম্বর উপকূল দিবস এর ভাবনা
১২ নভেম্বর উপকূল দিবস এর ভাবনা
প্রকাশ ঘোষ বিধান।।
উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়নসহ উপকূল সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে এবার দেশে এবার দ্বিতীয় বারেরমত ‘উপকূল দিবস’ পালিত হচ্ছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিন উপকূলের ৫৪ স্থানে একযোগে ‘উপকূল দিবস’ পালিত হবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, ঘূর্ণিঝড়ে প্রয়াতদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জলন এবং স্মারকলিপি পেশ।
যেভাবে শুরু হলো উপকূল দিবসের ভাবনা। ২০১৬ সালে ৭ সেপ্টেম্বর বুধবার খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার আমাদী জায়গীরমহল তকিমউদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সবুজ উপকূল কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। সেজন্য তার প্রায় ১ মাস আগে উক্ত স্কুলের ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে আলোকযাত্রা দল গঠন ও দেয়াল পত্রিকা ‘বেলাভূমি’ তৈরী করা হয়। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষে ঢাকা থেকে সবুজ উপকূল কর্মসূচীর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী ও আলোকযাত্রা দলের উদ্যোক্তা সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু ঢাকা থেকে পাইকগাছার ডাকবাংলায় প্রায় ৩ দিন অবস্থান করেন। আমাদী জায়গীরমহল তকিমউদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দেয়াল পত্রিকায় বেলাভূমি প্রস্তুত করার জন্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল এস ডব্লিউ নিউজ ২৪ ডটকম এর সম্পাদক ও প্রেসক্লাব পাইকগাছার সভাপতি প্রকাশ ঘোষ বিধান এবং রফিকুল ইসলাম মন্টু মটরসাইকেল যোগে কয়রা রওনা দেন। যাওয়ার সময় পথে উপকূলের বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে নানা আলোচনা করতে করতে এক সময় স্কুলে উপস্থিত হন। এরপর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত হয় আলোকযাত্রা দল। রফিকুল ইসলাম মন্টু সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় দেয়াল পত্রিকা তৈরীর প্রশিক্ষণ শেষে তৈরী হয় বেলাভূমি। দুপুরে আমাদী বাজারের নদীর পাশে একটি খাবার হোটেলে দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারা উপকূলবাসীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। উপকূল সুরক্ষার জন্য কিভাবে জনসচেতনতা বাড়ানো যায় তার উপর আলোচনা চলতে থাকে। আলোচনার মধ্যে প্রকাশ ঘোষ বিধান উপকূল সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য উপকূল দিবস পালন করা যায় কি না রফিকুল ইসলাম মন্টুর কাছে প্রস্তাব করেন। কথাটি বলার শেষ না হতে হতে তিনি বলেন, উপকূল দিবসের বিষয়টি নিয়ে আমার মাথার ভিতরে কয়েকদিন যাবৎ ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন প্রকাশ ঘোষ বলেন, আমরা উপকূল দিবস পালন করবো, আমরা দিবসটি পালন করা শুরু করি। উপকূল দিবসের জন্য একটি যুক্তিসংগত দিন খুঁজে বের করার জন্য রফিকুল ইসলাম মন্টুকে অনুরোধ করেন। এরপর অনুষ্ঠান শেষে রফিকুল ইসলাম মন্টু ঢাকা ফিরে যান। তিনি ঢাকায় ফিরে গিয়ে প্রকাশ ঘোষ বিধানকে জানান, ১২ নভেম্বর উপকূল দিবসের জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ বছর উপকূল নিয়ে পত্রিকায় প্রবন্ধ খেলা হচ্ছে, আপনি আপনার মত করে উপকূল দিবস নিয়ে লিখবেন। ২০১৬ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় রফিকুল ইসলাম মন্টু’র লেখা বের হয় “১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস”। আর প্রকাশ ঘোষ বিধানের স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক মানব কণ্ঠে প্রকাশিত হয় উপকূল দিবসের দাবীতে “উপকূল বাসীর সুরক্ষা নিশ্চিত হোক”। ২০১৬ সালে এভাবেই শুরু হয় উপকূল দিবসের সূচনা। তারপর ২০১৭ সালে প্রথম পালিত হয় উপকূল দিবস। ১২ নভেম্বর দ্বিতীয় বারের মত পালিত হচ্ছে উপকূল দিবস।
২০১৭ সালে প্রথমবার উপকূলের ২৪টি স্থানে দিবসটি পালিত হয়। আর এ বছর রাজধানী ঢাকা সহ উপকূলবর্তী ১৬ জেলার ৫৪ স্থানে দিবসটি পালিত হবে। স্থান গুলো হচ্ছে: কক্সবাজারের কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, মিরসরাই, সন্দ্বীপ; ফেনীর ফেনীসদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া; নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া; লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতি, রায়পুর; চাঁদপুরের চাঁদপুর সদর; ভোলার ভোলা সদর, যুগিরঘোল, চরফ্যাসন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, লালমোহন, দক্ষিণ আইচা; বরিশালের বরিশাল সদর; পটুয়াখালীর পটুয়াখালী সদর, কলাপাড়া, গলাচিপা, বাউফল, দশমিনা , রাঙ্গাবালী, পাখিমারা, কুয়াকাটা, চরকাজল; বরগুনার বরগুনা সদর, পরীরখাল, বেতাগী, তালতলী, পাথরঘাটা, বামনা, শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত; পিরোজপুরের কাউখালী, ইন্দুরকানী; ঝালকাঠির ঝালকাঠি সদর, কাঁঠালিয়া, নলছিটি; বাগেরহাটের বাগেরহাট সদর, শরণখোলা; খুলনার পাইকগাছা; সাতক্ষীরার সাতক্ষীরা সদর, তালা, শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনী, হরিনগর এবং রাজধানীর পল্টন।
উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির আহবানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের শতাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিবস পালনে এগিয়ে এসেছে। এরমধ্যে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যকর্মীদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি। দিবস পালনের প্রধান উদ্যোক্তা হিসাবে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উপকূল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ-সিজেএফবি, কোস্টাল ইয়ূথ নেটওয়ার্ক-আলোকযাত্রা। এবারের কর্মসূচিতে সহযোগী হিসাবে রয়েছে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, নির্ঝর এন্টারপ্রাইজ, দৈনিক খোলাকাগজ এবং বিডিমিরর একাত্তর ডটকম।
এত দিবসের ভিড়ে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস প্রসঙ্গে উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও উপকূল-সন্ধানী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতি নির্ধারকদের নজরবাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। এক যুগেরও বেশি ধরে উপকূল নিয়ে নিবিড়ভাবে রিপোর্টিং করতে গিয়ে আমি উপকূল দিবসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস থাকলে উপকূল ভাবনা সবার মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল, সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মহলে উপকূল-ভাবনার সুযোগ বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে উপকূল সুরক্ষা এবং সেখানকার নাগরিকেদের অধিকার নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে।
১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপকূলবাসীর কাছে স্মরণীয় দিন হিসাবে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরকেই ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ড-ভন্ড করে দেয় উপকূল। বহুমানুষ প্রাণ হারান। ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপ সমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে দশ লাখের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি।
জাতি সংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে গত বছরের ১৮ মে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলেরও পর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতি ঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে উইকিপিডিয়ার সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়।
’৭০-এর ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় স্মরণে এই দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে ঘোষণার দাবি ওঠে ২০১৭ সালে। সে বছর থেকেই দেশের সমগ্র উপকূল অঞ্চল জুড়ে উপকূল দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রথম বারের মত উপকূল দিবস পালনে গোটা উপকূল জুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। তারা উপকূলের জন্য একটি দিবসের দাবি তোলেন এবং ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। প্রথম বছরের বিপুল সাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবার দ্বিতীয় বছর আরও বৃহৎ পরিসরে উপকূল দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত, পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত সমুদ্ররেখা বরাবর উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগএলেই সংবাদ মাধ্যমে এদের খবরাখবর দেখা যায়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয়না। উপকূল দিবসের দাবি বাস্তবায়িত হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও উপকূলের বিশেষ খবরের দিকে সংবাদ মাধ্যমের নজর পড়বে। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূল সুরক্ষায় “বিশ্ব উপকূল দিবস” সময়ের যুক্তিসংগতদাবী। ১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস। ‘উপকূল দিবস’ পালনের মধ্যদিয়ে উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে। উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন সহ উপকূল সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশে দ্বিতীয় বারেরমত তালিকা হচ্ছে উপকূল দিবস। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এই দিনটি হোক ওয়াল্ড কোস্টাল ডে।
লেখক ঃ সাংবাদিক