বুধবার ● ২১ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » রাজনীতি » নড়াইল-২ আসনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মাশরাফির মনোনয়ন ॥ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর দিকে তাকিয়ে সবাই
নড়াইল-২ আসনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মাশরাফির মনোনয়ন ॥ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর দিকে তাকিয়ে সবাই
ফরহাদ খান, নড়াইল।
আনুষ্ঠানিক ভাবে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করেনি আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দল। এসব দলের মনোনয়ন কেনার পর প্রার্থীদের সাক্ষাতকার ও যাচাই-বাছাই চলছে দলীয় ভাবে। তবে এ মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মর্তুজার মনোনয়নের বিষয়টি। সত্যিই কী নড়াইল-২ আসন থেকে মাশরাফি মনোনয়ন পাচ্ছেন, নাকি অন্য কোনো আসনে? বিশেষ করে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও ফেসবুকে মাশরাফির প্রার্র্থীতা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের লেখালেখি এবং মন্তব্য করায় সবার মাঝে এ বিষয়ে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে মাশরাফি বা তার পরিবারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের কোনো নেতার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। এখন সবকিছু ছাপিয়ে ক্রিকেট মাঠের ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ এর চেয়ে আলোচনার তুঙ্গে আছেন ‘রাজনীতি মাঠের’ মাশরাফি বিন মর্তুজা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মাশরাফির প্রার্থীতার বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা না হলেও ইতোমধ্যে তার পক্ষে নড়াইলে নির্বাচনী কাজ শুরু করেছেন ভক্তসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।
এদিকে, নড়াইল-২ আসনে কে হচ্ছেন মাশরাফির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী? এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনা। বিশেষ করে ২০ দলীয় জোট তথা ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী, না অন্য দলের কেউ মাশরাফির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হচ্ছেন? এ নিয়ে নির্বাচনী মাঠে তুমুল আলোচনা চলছে। অপরদিকে, গত ১৬ নভেম্বর (শুক্রবার) বিকেলে নড়াইলের লোহাগড়ার একটি বিনোদন কেন্দ্রে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ওয়ার্কার্স পার্টির সমাবেশের পর থেকে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের চূড়ান্ত প্রার্থীতার বিষয়ে নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আওয়াজ তুলেছেন-এ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমান আবারো মনোনয়ন পাচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার (১৯ নভেম্বর) ধানমন্ডিতে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মনোনয়ন নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তালিকা মনগড়া; এগুলোর বাস্তবসম্মত কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের পক্ষ থেকে কাউকে এখন পর্যন্ত মনোনয়নের নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত অফিসিয়ালি তালিকা ঘোষণা না করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত জোটের মনোনীতপ্রার্থী কেউ দাবি করতে পারবে না। আগামী নির্বাচনের জন্য জোটগতভাবেই দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নড়াইল-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপত্র কিনেছেন-জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সহসভাপতি তবিবুর রহমান মনু জমাদ্দার, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার রিজভী জর্জ, নড়াইল-২ আসনের সাবেক এমপি মরহুম শরীফ খসরুজ্জামানের ছেলে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্মসম্পাদক শরীফ কাসাফুদ্দোজা কাফী, ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ খুলনার সদস্য সচিব; নড়াইলের লোহাগড়ার কুচিয়াবাড়ি গ্রামের সন্তান অধ্যাপক ডাঃ সেখ মোহাম্মাদ আখতার-উজ-জামান, জেলা বিএনপির যুগ্মসম্পাদক খন্দকার ইজাজুল হাসান বাবু ও শাহরিয়ার আলম। এছাড়া জোটের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ডক্টর ফরিদুজ্জামান ফরহাদও এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন নড়াইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম নাসির উদ্দীন এবং এনপিপির (ছালু) জেলা সভাপতি মনিরুল ইসলাম নিজ দলের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন বলে জানিয়েছেন। যদিও প্রথম দিকে এনপিপির একাংশের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ছালাউদ্দিন ছালু নিজে নড়াইল-২ আসনে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব প্রার্থীর মধ্যে কেউ মাশরাফির প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন, নাকি অন্য কেউ; বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে।
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার রিজভী জর্জ বলেন, দলীয় মনোনয়ন কিনেছি। তরুণ প্রার্থী হিসেবে নড়াইল-২ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী শরীফ কাসাফুদ্দোজা কাফী বলেন, দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী। এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার (১৯ নভেম্বর) সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়েছে। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, এবারের নির্বাচনে জোট থেকে মনোনয়ন না দিয়ে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়ার প্রত্যাশা করছি। নড়াইলে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও বিগত ২০০১ সালে জোট থেকে মনোনয়ন দেয়ায় আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি করেন তিনি।
এদিকে, নড়াইল-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাসহ ১৭ প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এরা হলেন-আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য শিল্পপতি শেখ আমিনুর রহমান হিমু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ নূরুজ্জামান, জেলা আ’লীগের সহসভাপতি সৈয়দ আইয়ূব আলী, এস এম আসিফুর রহমান বাপ্পি, সাবেক সংসদ সদস্য এস কে আবু বাকের, শিল্পপতি বাসুদেব ব্যানার্জি, লোহাগড়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা লে. কর্নেল সৈয়দ হাসান ইকবাল, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাসানুজ্জামান, রাশিদুল বাসার ডলার, অ্যাডভোকেট শেখ তরিকুল ইসলাম, যুব মহিলা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শারমিন সুলতানা শর্মী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা মুন্সী কামরুজ্জামান কাজল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান তাপস ও সুজন রহমান।
মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান ও জেলা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সভাপতি অ্যাডভোকেট ফায়েকুজ্জামান ফিরোজ দলীয় মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আমিনুর রহমান হিমু বলেন, দলীয় মনোনয়ন কিনেছি। তবে মনোনয়ন কাকে দিবেন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীই ভালো জানেন। সামর্থ্য অনুযায়ী আমি নড়াইলবাসীর জন্য সব সময় কাজ করে যাবো ইনশা আল্লাহ। শুধু এমপি হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এলাকায় ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন করিনি; সবার স্বার্থেই কাজ করেছি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস বলেন, দল যাকে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে; তার পক্ষেই আমরা কাজ করব। স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ নূরুজ্জামান বলেন, নড়াইল-২ আসনে মনোনয়ন কিনেছি। দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন, তার জন্য নির্বাচনী মাঠে নামব। জাপা নেতা ফায়েকুজ্জামান ফিরোজ বলেন, রাজনীতির মাঠে নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে আমার। নড়াইল-২ আসনে রাজনৈতিক নেতারাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন-এমনটি প্রত্যাশা করছি।
এদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কেনার পর মাশরাফি ভক্তসহ দলীয় নেতাকর্মীরা তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও যুব মহিলা লীগের আয়োজনে গত শনিবার (১৭ নভেম্বর) বিকেলে নড়াইল সদর উপজেলার বেনাহাটি গ্রামে মাশরাফির জন্য ভোট চেয়ে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বক্তারা বলেন, মাশরাফি দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী মাশরাফিকেই নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিবেন। এর আগে গত ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় নড়াইল শহরের চৌরাস্তা থেকে মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্য মিছিল বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন নড়াইল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর বিশ্বাসসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। মাশরাফি… মাশরাফি…, নৌকা… নৌকা…শ্লোগানে মিছিলটি মুখরিত হয়ে উঠে। এছাড়া ১২ নভেম্বর বিকেলে নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া বাজার এলাকায় ইউনিয়ন যুবলীগের আয়োজনে মাশরাফির পক্ষে নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় নেতাকর্মীরা বলেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাইজপাড়া ইউনিয়নের কৃতি সন্তান হিসেবে মাশরাফি বিন মর্তুজার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে আ’লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, সৎ, ত্যাগী, উন্নয়নকামী ও তৃণমূলের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখেন; এমন নেতাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার জন্য আমরা দলের কাছে দাবি জানাচ্ছি। এতে এলাকার উন্নয়ন হবে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যের সাথে এলাকাবাসীর সম্পর্ক বজায় থাকবে।
জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল-২ আসনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫১১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৬০ হাজার ৬২৪ এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৮৭ জন। নড়াইল ও লোহাগড়া পৌরসভাসহ এ আসনের অধীনে সদর উপজেলায় আটটি ইউনিয়ন এবং লোহাগড়ার ১২টি ইউনিয়ন রয়েছে। এ আসনে পাঁচবার আ’লীগ, দুইবার করে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং একবার মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হন। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন-এটাই দেখার অপেক্ষায় আছেন নড়াইল-২ আসনের ভোটারসহ জনসাধারণ।