বুধবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » ফিচার » সমবায় আন্দোলনের প্রেক্ষাটপ
সমবায় আন্দোলনের প্রেক্ষাটপ
প্রকাশ ঘোষ বিধান
সমবায় বিশ্বাব্যাপী একটি আদর্শ ও সামাজিক আন্দোলন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে সমবায়। দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের কাঙ্খিত মুক্তির হাতিয়ার। সমবায় দারিদ্রপীড়িত, বিত্তহীন ও নিুবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংগঠন। এর লক্ষ্য শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করা।
আমদের দেশে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার সমবায় দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে সম্পদের মালিককানায় সমবায়কে একটি পৃথক ও দ্বিতীয় খাত হিসেবে ঘোষণা কার হয়। সমবায়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় সমবায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমবায় অধিদপ্তর, সমবায় সমিতি সমবায়ীসহ সমবায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করছে। দেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য সমবায়ী ও সমবায় সমিতি সমূহের কর্মকান্ডকে উৎসাহ প্রদানের জন্য সরকার প্রতিবছর শ্রেষ্ঠ সমবায়ী ও শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি গুলোকে পুরস্কার প্রদার করে। এ পুরস্কার একজন সমবায়ী ও সমবায় সমিতির জন্য সর্বউচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী ও সমবায় সমিতিগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়। এবছর ৭ নভেম্বর সমবায় দিবস পালিত হয়েছে।
সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরানো। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর হাজার হাজার শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়ে যখন বেকারত্বের কঠিন অভিশাপে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছিলেন। সেই সময় ইংল্যান্ডের রচডেল নামক গ্রামের ২৮জন তাঁতী ২৮ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমিতি সমবায়ের পদপ্রদর্শক হিসাবে পরিচিত। ইংল্যান্ডের রচডেল গ্রামের সমবায়ীদের সমবায় সমিতি পৃথিবীর প্রথম সফল সমবায় সমিতি হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সমবায়ের সুদীর্ঘ এক’শ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। সমবায়ে আন্দোলনের পুরোধা জগত বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়। তিনি খুলনা জেলার পাইকগাছার রাড়–লী গ্রামের মানুষদের দারিদ্র বিমোচন এবং আত্মনির্ভরশীল করতে এলাকার মানুদের সমবায়ের আদর্শে উদ্ভোদ্য করে তোলেন। ১৯০৪ সালে ভারত বর্ষে বিধিবদ্ধ সমবায় আইন চালু হলে ১৯০৬ সালে রাড়–লীসহ অন্যান্য এলাকায় ৪১টি কৃষি ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। ১৯০৮ সালে পিসি রায় ও তার ভাই নলিনী কান্ত রায়চৌধুরীর প্রচেষ্টায় সমবায় সমিতিগুলোকে নিয়ে রাড়–লী সেন্ট্রল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করেন। এটি ভারতবর্ষের ৩য় সমবায় ব্যাংক। যা ঐতিহ্যের সাথে এখনো চলমান।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে সমবায়ের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিু মধ্যবিত্ত জনগনের একারপক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেখানে প্রয়োজন হয় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার। সমাজের বিত্তহীন ও নিুবিত্ত মানুষদের শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করে তাদের দারিদ্র বিমোচন ও স্ব-নির্ভরতা অর্জন করাই সমবায়ের লক্ষ্য। সমবায় কোন রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সংগঠন নয়। এখানে সকল সদস্যদের সমান অধিকার থাকে। ১শত৭১ বছরের সমবায়ের আদর্শকে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন বা ক্ষমতার পট পরিবর্তন বিচ্যুত করতে পারেনি। সমবায়ের অগ্রযাত্রা দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। দারিদ্র বিমোচনে সমবায়ের নীতি ও আদর্শ আন্তজার্তিক ভাবে স্বীকৃত। সমবায়ের প্রতীক সাত রঙে মিশে সৃষ্টি হয় সাদা। আর সাদা হচ্ছে শান্তির প্রতীক। দারিদ্র বিমোচন নিুবিত্ত মধ্যবিত্ত ও সকল স্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফসল সমবায়। একজন দারিদ্র ব্যক্তি যখন দারিদ্র সীমা অতিক্রম করে স্বচ্ছল জীবনযাপন করে তখন সে স্ব-নির্ভর হিসাবে স্বীকৃত পায়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে মূলধন সৃষ্টি করে সবলম্বী হওয়া সমবায়ের মূল লক্ষ্য। দারিদ্র ও অবহেলিত মানুষের কাঙ্খিত মুক্তির পথ হচ্ছে সমবায়।
দারিদ্র বিমোচন ও স্ব-নির্ভরতা অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ধারক বাহক সমবায় পদ্ধতি। তারপরও আমাদের সমবায় সমিতিগুলো কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছে না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কঠোর বিধিনিষেধ থাকা সত্বেও শৃঙ্খলার মধ্যে আসছে না দেশের সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে অলিত-গলিতে গড়ে উঠেছে ভূইফোড় সমবায় সমিতি। অভিযোগ রয়েছে, কথিত এসব সমবায় সমিতি ক্ষুদ্র ঋণ কর্যক্রমের আড়ালে নির্দ্বিধায় করছে ব্যাংকিং ব্যবসা। আর তাদের লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেবার নামে বিশেষ ক্ষেত্রে এনজিও শতকরা ৩০-৩৫ টাকা পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। আরএ অধিক মুনাফার আশায় অনেক ব্যক্তি বা এনজিও ধারণা সম্পন্ন ব্যক্তি সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে বিভিন্ন কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে সমবায়ের আইন ও নিয়মাবলি উপেক্ষা করে সমিতি পরিচালনা করছে। এই অপরিকল্পিত উদ্যোগে ও এনজিওর মত উচ্চ হারে সুদ নিয়ে গুটি কয়েক ব্যক্তি টাকার পাহাড় গড়ছে। এতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না বরং শোষণ এবং শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের উদ্যোগ থাকার পরও সৎ যোগ্য নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও সুষ্টু তদারকির অভাবের সমবায় আন্দোলন উন্নতি করছে না। এসব কারণে সমবায় সমিতিগুলো রুগ্ন হচ্ছে এবং মুখ থুবড়ে পড়ছে। সমবায়ের এই দুর্বলতার সুযোগ দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো সেবার নামে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ব্যক্তি সুবিধা ভোগ করছে। তবে সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চেষ্টা করছে। তাছাড়া সমবায় সমিতির দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে সমবায়ীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও তদারকির প্রয়োজন। সেই সাথে সমবায় সমিতিগুলোতে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে সমবায় আন্দোলন দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উল্লোখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।