শনিবার ● ৩ আগস্ট ২০১৯
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » এক প্রাঞ্জ রাজনীতিক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
এক প্রাঞ্জ রাজনীতিক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়–লী গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি একাধারে একজন আদর্শ শিক্ষক, প্রাঞ্জ রাজনীতিক, সফল শিল্পস্রষ্টা, ভারতবর্ষে বিজ্ঞানী গড়ার কারিগর, বিখ্যাত সমাজসেবক, সু-সাহিত্যিক এবং বহুগুনের অধিকারী এক মহান দেশপ্রেমিক। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের ক্ষনজন্মা পুরুষদের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় অন্যতম। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ শাসন সংহত করার বিশেষক্ষণে রামমোহন-বিদ্যাসাগর- কেশবচন্দ-দ্বারকানাথ প্রমুখের নেতৃত্বে বাঙালি রেনাসাঁর ঢেউ যুগ পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে সমাগত, সিপাহী বিদ্রোহের আলোড়িত করেছিল সমাজের উপরিমহলকে। এ রকম একটা সময়ে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম।
১৮৮৩ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ব্রিটেনের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বি,এস,সি ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৮৫ সালে তিনি বি,এস,সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই তার মনের যন্ত্রনা প্রকাশের সুযোগ এলো। কারণ সে সময় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর স্যার স্টাফোর্ট নর্থকোট ঘোষণা দিলেন, সিপাহী বিদ্রোহের আগেও পরে ভারতবর্ষের অবস্থা শীর্ষক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার। এ সময় তার সামনে বিএসসি পরীক্ষা তবুও জাতীয়তাবোধ স্বদেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে এই প্রতিযোগিতা মুলক প্রবন্ধে রচনায় অংশ গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসকের অন্যায়, অবিচার আর ভারতবাসীর উপর অত্যাচারের নগ্ন চিত্র প্রবন্ধে তিনি উম্মোচন করেন। সে প্রবেন্ধে যুক্তি-তর্কের বাক্যবানে ব্রিটিশ সরকারের ভীত কেপে উঠেছিল। তিনি ব্রিটিশ সরকারের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন ভারতবাসীকে তারা কিভাবে শোষন করেছে। সত্য প্রকাশে নির্ভিক ভারতীয় ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায় যুক্তি-তর্কের যাদুস্পর্শে এক পর্যায়ে বলেছিলেন, “আশাকরি আপনাদের সম্রাজ্যের মৃত্যুকুপ বেজে উঠেছে। আর অধিকতর উজ্জ্বল যুগের সূচনা হবে ভারতে”। প্রবন্ধে তিনি ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনের নামে শোষনের নিখুত বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার, অবিচার, জনগণের উপর নানারকম করের বোঝা চাপানোর প্রভৃতি বিষয় তিনি পুনখানুপুংখ রুপে উপস্থাপন করেন। তিনি লিখিছিলেন “দুর্দশাগ্রস্থ সাধারণ মানুষ, নুন কেনার ক্ষমতা নেই, সমুদ্রের ধার থেকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে যে খানিকটা তুলে আনে, এই দিয়ে ভাত খায়। রাজস্ব না দেওয়ার অপরাধে এদের শাস্তি হয়, যেন এরা নিষিদ্ধ কোন কাজে যুক্ত রয়েছে। এর নিন্দে করার কোন ভাষা নেই। আরোও লিখেছেন দেশের কলেজ ও গবেষনাগারগুলিতে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ভারত সরকার টাকা দিতে পারছে না। সে সরকার দুর্গকে “রাজ প্রসাদ” করার জন্য এক কোটি পাউন্ড খরচ করতে পারে, গবেষনাগারের জন্য এক ফার্দিনও খরচ করতে পারে না, তার মস্তক থেকে সভ্য সরকারের শিরোপা কেড়ে নেয়া হোক। পরাধীন ভারতের দেশ প্রেমের উজ্জীবিত যুবক প্রফুল্ল চন্দ্র যেদিন বিলেতে ব্রিটিশের বুকে বসে ভারত বর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ধ্যার্থহীনভাবে লিখেছিলেন, “ভারতীয় সরকার এক কর আদায়ের যন্ত্র। কিছুতেই তাকে জনগণের সরকার বলা যায় না। ব্রিটিশ সরকার প্রফুল্ল চন্দ্রের এ বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি। পুরস্কার তো দুরের কথা। ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি ছিলেন ছদ্ধবেশী বিপ্লবী ছাত্র।
ব্রিটিশ সরকার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উপর ক্ষুব্ধ হলেও ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মওলী তাকে যথার্থ মুল্যায়ন করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে বিএসসি পরীক্ষায় প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শ্রেষ্ঠ ৫০০ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। সে বছর তিনিই একমাত্র গবেষক ছাত্র হিসাবে ডিএসসি ডিগ্রী ভাল করার সুযোগ পান। তার মৌলিক গবেষনাপত্রে খুশি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৮৮৭ সালে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করেন এবং এ কৃতিত্বের সুবাদে ১৮৮৮ সাথে “হোপপ্রইজ” বৃত্তিলাভ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোটাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন।
প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিজ্ঞানী হলেও দক্ষ রাজনীতিক ছিলেন। দেশের সংকটময় মুহুর্তে যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সহ গুরুত্বপূর্ন নেতারা রাজবন্দী তখন তিনি বিজ্ঞানাগার ছেড়ে বীরত্বের সাথে রাজনৈতিক মঞ্চে উঠেছিলেন এবং দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন “বিজ্ঞান অপেক্ষা করতে পারে কিন্তু স্বরাজ অপেক্ষা করতে পারে না”। তিনি স্বরাজ জয়ের সহযোগি হিসাবে কখনও মহামতি গোখলে, মহাত্না গান্ধীর মতবাদ, আবার কখনো নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নীতির প্রতি সমার্থন জানিয়েছিলেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন অহিংসা কিম্বা সহিংস সেভাবেই হোকনা কেন ভারতে স্বাধীনতা আসুক। তার রাজনীতির দুরদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে একজন ইউরোপিয়ান বলেছিলেন, মহাত্ম গান্ধী যদি আর দুই জন পিসি রায় পেতেন তাহলে ভারত অনেক আগেই স্বরাজ পেতেন। ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ানের এক সংবাদদাতা এ কথা লিখেছিলেন।
১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গের ঘোষনা কে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯০৯ সালে মহাত্ম গান্ধী গোষলের সাথে কলকাতায় আসেন। সে সময় গান্ধী সাথে প্রফুল্লচন্দ্রের আলাপ হয় এবং কংগ্রেস রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯২৫ সালে মহাত্ম গান্ধী খুলনায় অসহযোগ আন্দোলন প্রচারে খুলনায় এলে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্টিমার ঘাটে স্বাগত জানান। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন সম্বধনা কমিটির সভাপতি। এরপর ১৯২৫ সালে কোকনাদ কংগ্রেস কনফারেন্সে প্রফুল্লচন্দ্র রায় সভাপতিত্ব করেন। একই সময় কাটিপাড়ায় “ভারত সেবাশ্রম” নামে একটি স্থাপন করে নিজ জন্মভূমির এলাকার মানুষের চরকায় সুতা কাটার মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম লেখা ছিল বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারী রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে সভায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষনাগারেই আমার কাজ, কিন্তু এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিকেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়। আমি অনিষ্ট কর এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি। ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন খদ্দর প্রচারের সময় প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন অন্যতম প্রধান বক্তা। ১৯২৭ সালের জুন মাসে আচর্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের খুলনা জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পরাধীন বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অবদান অপরিসীম। তিনি আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি ১৮৯৫ সালে মারকিউরাস নাইট্রাস আবিস্কার করে বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তার বিশেষ কৃতকার্যের জন্য নাইট উপাধি দেন। এ মহান দেশপ্রেমিক সারাজীবন দেশের কল্যাণে কাজ করে ১৯৪৪ সালে ১৬ জন মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক ঃ সাংবাদিক