বৃহস্পতিবার ● ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » সাহিত্য » পাইকগাছার প্রত্যান্ত গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এনতাজ আলী পাঠাগার
পাইকগাছার প্রত্যান্ত গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এনতাজ আলী পাঠাগার
প্রকাশ ঘোষ বিধান।
খুলনা জেলরা পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যান্ত গ্রাম হিমাতপুরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এনতাজ আলী স্মৃতি পাঠাগার। খুলনা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত এ পাঠাগার। উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উত্তরে গদাইপুর ইউনিয়ানের একটি গ্রাম হিতামপুর। খুলনা-পাইকগাছা সড়কের নতুন বাজার থেকে কাঁচাপাকা সড়ক ধরে ১৫-২০ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথে কপোতাক্ষ নদের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা গ্রামটি সৌন্দর্য অপরূপ। গ্রামের পাখপাখালি ও নদীর কলধ্বনির মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘এনতাজ আলী স্মৃতি পাঠাগার’। এক সময়ে সুনামধন্য রাজনীতিবিদ ও সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী তার পিতা এনতাজ আলী নামে এই পাঠাগার গড়ে তোলেন।
এই গ্রামে ও এই ভবনে ১৯২৮ সালে ২৮ আগস্ট জম্মগ্রহণ করেন শেখ রাজ্জাক আলী। তাঁর পিতা ছিলেন, শেখ এনতাজ আলী ও মাতা গোলচেয়ারা বেগম। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রাজ্জাক আলী ছিলেন সবার ছোট। তিনি নিজ গ্রামে মক্তব ও বোয়ালিয়া হিতামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তিনি বরাবর ভাল ছাত্র ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কপোতাক্ষ নদের অপর পাড়ে আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র ইনসটিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। পরে খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল (বিএল) কলেজ থেকে এইচএসসি ও ¯œাতক পাশ করেন। পরে ১৯৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিকে এমএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে এলএলবি পাশ করে। ১৯৬৭ সালে আবার বাংলায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে বেগম মাজেদা আলীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবাদ্ধ হন। বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দলে সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অবশেষে ১৭৭৯ সালে কয়রা পাইকগাছা থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করেন ও সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ তিনি খুলনা-২ এর সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ৫ এপ্রিল তিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও ১২ অক্টোবর স্পিকার নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালে ৭ জুন খুলনার ফারাজিপাড়ায় নিজ বাস ভবনে মারা যান।
শহরে ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত প্রত্যান্ত এই গ্রামে শিক্ষার আলো তখন পৌঁছায়নি। গুটি কয়েক পরিবারের শিক্ষার চর্চা শুরু করে। এনতাজ আলীর পরিবার তার মধ্যে একটি। দরিদ্র সীমার নিচে থাকা এই এলাকার মানুষের একমুঠো চাল যোগাড় করতেই দিন কেটে যেত। তাই তাদের ভাগ্যে শিক্ষা জোটেনি। শিক্ষা জীবন থেকে এই দিকটা ভাবিত করত রাজ্জাক আলীকে। গ্রামের মানুষ যাতে জ্ঞান চর্চা করতে পারে, অবসর সময়ে একটু খবরের কাগজ পড়তে পারে সেই ভাবনা থেকেই এই পাঠাগারটি গড়ে তোলেন ২০১৩ সালে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি যাতে সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হতে পারে তার জন্য তিনি শেখ রাজ্জাক আলী ও বেগম মাজেদা আলী ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
পাঠাগারটির দ্বিতলা ভবনের নিচ তলায় ৩টি কক্ষ নিয়ে পরিচালিত হয়। দুটি পাঠ কক্ষ ও একটি লাইব্রেরিয়ানের কক্ষ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সাজানো গোছানো আলমারীতে বইগুলো। কয়েকজন পাঠক বই পড়ছেন। এদের মধ্যে কেউ আবার পত্রিকা পড়ছেন। লাইব্রেরিটি সকাল ১০টায় খোলা হয় আর বিকাল ৪টায় বন্ধ করা হয়। লাইব্রেরি গড়ে তোলার পেছনে ইতিহাস জানান, বেগম মাজেদা আলী ও লাইব্রেরির রেজিস্ট্রার শেখ আব্দুল আজিজ। এই লাইব্রেরিটি তার সর্বশেষ গড়া প্রতিষ্ঠান। লাইব্রেরিটি সরকারি নিবন্ধনও পেয়েছে প্রতিষ্ঠার বছর। তার ব্যবহৃত সব বই এই পাঠাগারে তিনি দান করেছেন। পাঠাগারের দুই হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। এখানে ৪টি দৈনিক পত্রিকা, ১টি সপ্তাহিক ও একটি মাসিক পত্রিকা রাখা হয়। চাকরি প্রত্যাশিদের জন্য রাখা হয় একটি চাকরির খবর পত্রিকা। প্রতি বছর ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, গান, নৃত্য ও নাটকের আয়োজন ও পুরস্কার দেওয়া হয়।
এই এলাকার একটি অংশ জেলে (মালো)। সাগরে মাছ ধরে তাদের জীবন চলে। এই কাজের জন্য তারা বছরের ৬ মাস বাড়ি ছাড়া থাকে। এসময় তারা বৌ-বাচ্ছা নিয়েই মাছ শিকারের যায়। এছাড়া বাকী জনগোষ্ঠির এক বড় অংশ ইট তৈরির মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজে চলে যায়। তারাও পরিবার পরিজন সঙ্গে নিয়ে যায়। ফলে তাদের সন্তানেরা মুল ধারার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকে অভাবের তাড়নায় বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে না। এসব শিক্ষার্থীরা এই লাইব্রেরিতে বসে বা বাড়িতে বই নিয়ে কিছুটা হলেও শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করেন। বিনা খরচে এনতাজ আলী স্মৃতি পাঠাগারের এই সুযোগ রয়েছে।
বেগম মাজেদা আলী বলেন, তখন গ্রামের মানুষ খুব একটা শিক্ষিত হয়নি। ওদের (রাজ্জাক) পরিবারের কিছু মানুষ লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকে মূলত তিনি চাইতে গ্রামের মানুষ শিক্ষিত হবে। অবসরে একটু খবরের কাগজ পড়ছে। দুটি বই পড়বে। আজেবাজে আড্ডা দেবে না। সেই সময়টা বই পড়বে। তাছাড়া শহরে তো হাতের লাগালে বই পাওয়া যায়। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি রয়েছে, বিভাগীয় গণগ্রন্থগার রয়েছে, বেসরকারি উদ্যোগে অনেক লাইব্রেরি হয়েছে। কিন্তু গ্রামের বই পাওয়া খুব কঠিন। কারণ সেখানে কেউ নিজ খরচে লাইব্রেরি করবে সেই পরিমাণ অর্থ তো তাদের নেই। পাঠ্যপুস্তাকের বাইরে শিক্ষা নেওয়া খুব কঠিন। এসব ভেবে তিনি ২০১২ সালে এই লাইব্রেরি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। কিন্তু হঠাৎ ওই বছরের মাঝামাঝি সময় তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর ফলে কাজে কিছুটা ধাক্কা লাগে। কিন্তু পিছিয়ে না গিয়ে ২০১৩ সালে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করে। ওই বছর এটি সরকারি ভাবে নিবন্ধন পায়।
লাইব্রেরি আরও বড় করার ও আধুনিকায়ন করা ইচ্ছা ছিল রাজ্জাক আলী। ক্যান্সার হওয়ার পরে সেই স্বপ্নে ভাটা পড়ে। চিকিৎসায় বেরিয়ে যেতে শুরু লাইব্রেরিকে আধুনিকায়নের টাকা। তবু তিনি থেমে থাকেনি। সুযোগ পেলেই লাইব্রেরির জন্য বই কিনেছেন। লাইব্রেরিতে বইয়ের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আতœজীবিনী, বাংলা পিডিয়া, হাজার বছরের বাঙালীর সংস্কৃতি, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, হুমায়ন আহমেদর নানা ধরণের রচনা, নজরুল রচনাবলী, হাসান হাফিজুর রহমানের প্রবন্ধ সমগ্র, রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কবিতা, খুলনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রামায়ন, মহাভারত। লাইব্রেরিতে রয়েছে একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন পরিছন্নকর্মী। লাইব্রেরিয়াকে প্রতিমানে ৮হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। পরিছন্নকর্মী ২ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল, পত্রিকাসহ মাসে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। পুরো টাকাটাই এই ট্রাস্ট থেকে খরচ করা হয়।
লাইব্রেরি থেকে প্রতিবছর ৮/১০ জন এসএসসি পাশ মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ পিতৃ-মাতৃ হীন আবার কেউ হত দরিদ্র। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২জন চিকিৎসক হয়েছেন। প্রতিমাসে প্রয়োজন অনুযায়ী ৫/৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়। গত বছর শহীদ জিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২টি ফ্যান ও একটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়ে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেওয়া হয়। এই লাইব্রেরির ২৮২ জন সদস্য রয়েছে। আশা-পাশের গ্রামগুলোর পাঠক লাইব্রেরিতে এসে বই পড়েন। আবার অনেকে এখান থেকে বই নিয়ে বাড়ি বসে পড়েন। সাত দিনের জন্য বই নেওয়া যায়। সাতদিন পরে ওই বই জমা দিয়ে নতুন বই নিয়ে থাকে পাঠকরা। প্রতিদিন ১০-১৫ জনের মত পাঠত বই পড়তে আসে। প্রতিদিন ৮-১০ জন করে বই নিয়ে যায়।
শেখ আব্দুল আজিজ বলেন, এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের পক্ষে বই কিনে পড়ার ক্ষমতা নেই। এলাকাটির অধিকাংশ মানুষ গরীব। প্রতিদিনের কর্মের মধ্যে তাদের খাওয়া নির্ভর করে। এখানে মানুষ কৃষি নির্ভর। সেখানে বই কেনার টাকা পাবে কোথায়। তাছাড়া এটি একটি প্রত্যেন্ত গ্রাম। এখানের খবরের কাগজ ও আসে দেরিতে। অনেকের ইচ্ছা থাকলেও বই ও পেপার কিনতে পারে না। তারপরেও শিক্ষার হারও কম। রাজ্জাক সাহেবদের পরিবার ছিল ব্যবসায়ী ও মধ্যবৃত্ত। তিনি লেখাপড়া করার সময় যোগাযোগের অভাবে অনেক সময় ঠিক সময়ে দরকারি বইটি পাননি। পরে তিনি যখন শিক্ষিত হলেন সংসদ সদস্য হলেন তখন থেকে এলাকায় কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। তিনি এলাকায় উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। পাইকগাছা কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা, শহীদ জিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, হিতামপুরের মসজিদ, পাইকগাছায় বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে ট্রাস্ট গঠন করেন। সে ধারা বাহিকতায় এখানে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছিলেন বইয়ের মাধ্যমে শহরকে গ্রামে আনতে। গ্রামের মানুষ যাতে নানা ধরণের বই পড়ে নিজেদের উন্নত করতে পারে। পত্রিকা পড়ে দেশ-বিদেশের খরব জানতে পারে। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন লাইব্রেরির গতি অনেক কমে গেছে। তারপরে এলাকার সার্থে এটি আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সংকট অর্থের।
পাঠক শেখ ফয়সাল হোসেন বলেন, সাধারণত আমারা আতœজীবনী পড়তে খুব ভাল লাগে। আতœজীবনী মাধ্যমে প্রত্যেকের জীবনের নানা রকম কাহিনী জানা যায়। আমি নিয়মিত এখানে বই পড়তে আসি। এই লাইব্রেটির জন্য অনেক বই ও নিয়মিত বই পড়তে পারি। আমাদের খুব উপকা হয়।
লাইব্রেরিটি বড় কররার স্বপ্ন দেখেন মাজেদা আলী। এটি হবে ডিজিটাল লাইব্রেরি। পাঠকরা এখানে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বই পড়তে পারবেন। শিক্ষার্থীরা এখানে বসে দেশের ও দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোর খবরাখবর নিতে পারবে। এখানে বসে চাকরির অনলাইন ফরম পূরণ করতে পারবে। রাজ্জাক আলী মারা যাওয়ার সেই স্বপ্ন অনেটা ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বড় করতে হলে আরও লোক নিয়োগ করতে হবে। তখন তাদের বেতন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি বেশি বই কিনতে হবে। কিন্তু অর্থে সংকটে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
মাজেদা আলী বলেন, এখন আমার ৮৪ বছর বয়স। চোখে আর ভাল দেখি না। ট্রাস্ট্রে তেমন টাকা নেই। আমারও ব্যক্তি তেমন টাকা নেই। তাই আমার নিজের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটি বড় করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমার মেয়েরা এটি দেখভাল করে। তারা যদি এটিকে বড় করতে চায় তবে করবে। বর্তমান সরকারের কাছ থেকে এখন তো আর আশা করতে পারি না। তবে এটির উন্নয়ন হলে প্রত্যান্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকার পাবে।
পরিবেশ বাদী সংগঠন বনবিবি’র সদস্য কবি মাধুরী সাধু বলেন, প্রত্যান্ত গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এই পাঠাগারটি। প্রয়োজনে আমরা সেখানে বইপত্র সংগ্রহ করি। মুল ধারার শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো এই লাইব্রেরির মাধ্যমে বেশ উপকার পাচ্ছে। শহরের শিক্ষা সাথে গ্রামের শিক্ষার যে ব্যবধার রয়েছে তা ঘোচাতে পাঠাগারটি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে চলেছে।