বৃহস্পতিবার ● ৬ মে ২০২১
প্রথম পাতা » অপরাধ » পাইকগাছায় স্ত্রীকে হত্যার পর শ্যালিকাকে অপহরণ করে আটক রেখে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ মামলায় রিমাণ্ড শেষে জেলহাজতে মশিয়ার
পাইকগাছায় স্ত্রীকে হত্যার পর শ্যালিকাকে অপহরণ করে আটক রেখে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ মামলায় রিমাণ্ড শেষে জেলহাজতে মশিয়ার
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা ঃ স্ত্রীকে হত্যার পর শ্যালিকাকে অপহরণ করে আটক রেখে ধর্ষণের পর ভিডিও চিত্র ধারণ করার মামলায় রিমাণ্ড শেষে বুধবার পাইকগাছার মাছ ব্যবসায়ি মশিয়ার সরদারকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে স্ত্রীকে নির্যাতন চালিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার মশিয়ারসহ পাঁচজনকে আসামী করে আদালতে দায়েরকৃত মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন খুলনা জেলার পাইকগাছার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম পলাশ কুমার দালাল। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কালুয়া গ্রামের এক ইটভাটা শ্রমিক এ মামলা দায়ের করেন।
এ মামলার অপর আসামীরা হলেন পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালি ইউনিয়নের কালুয়া গ্রামের মশিয়ারের ভাই মহসিন সরদার, তার বাবা কামরুল ইসলাম সরদার, মা সানোয়ারা বেগম ও তাদের আত্মীয় চাঁদমুখী গ্রামের মোজাম সরদারের ছেলে মান্নান সরদার।
এদিকে স্বপরিবারে স্ত্রীকে হত্যা করে আত্মহত্যার প্রচার দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করার পর শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে শ্যালিকাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে অন্যত্র আটক রেখে উপর্যুপরি ধর্ষণ ও ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা ও স্ত্রী হত্যার মামলার আসামী মশিয়ার রহমানকে তিন দিনের রিমাণ্ড শেষে বুধবার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনার বিবরনে জানা যায়, পাইকগাছা উপজেলার কালুয়া গ্রামের মাছ ব্যবসায়ি মশিয়ার রহমান সরদার নিজের স্ত্রী থাকার পরও পরকীয়ার কারণে ২০১২ সালে বড় ভাই মহসিনের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর স্থানীয়রা তাদেরকে কয়রা উপজেলা সদরের এক বাড়ি থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে। পরে মশিয়ার ও তার ভাই মহসিনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন একই দিনে এসে এক শালিসি বৈঠকের মাধ্যমে দু’ মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। জনসাধারনের আই ওয়াশ করতে কামরুল সরদার ছেলে মশিয়ারকে মাদকাসক্ত দেখিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে এক সপ্তাহ পর আবার জামিনে মুক্ত করে আনেন। এর কিছুদিন পর মশিয়ার ভাল হয়ে গেছে দাবি করে একই গ্রামের এক ভাটা শ্রমিকের মেয়ের সঙ্গে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর মশিয়ারের বিয়ে দেন বাবা কামরুল। বর্তমানে তাদের সাড়ে চার বছরের এক ছেলে আছে। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীকে নানান অজুহাতে নির্যাতন করতো মশিয়ার ও তার পরিবারের সদস্যরা। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ওই গৃহবধুকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মশিয়ার ও তার পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে নিহতের বাবা মাদারীপুর জেলা সদরের শীলাচর ইউনিয়নের চরলক্ষীপুর গ্রামের চেয়ারম্যান ঘাট এলাকার পদ্মা ব্রিকস এ কর্মরত শ্রমিক বাড়িতে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ সুযোগে শোকাতুর পরিবারের সদস্যদের উপর প্রভাব খাটিয়ে গৃহবধু ওজু করতে উঠে পানিতে পড়ে মারা গেছে প্রচার দিয়ে ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পরিহিত হলুদ রং এর শালোয়ার কামিজ সরিয়ে ফেলে অন্য পোশাক পরিয়ে পুলিশকে না জানিয়ে কৌশলে পারিবারিক কবরস্থানে নিহতের লাশ দাফন করে মশিয়ার ও তার পরিবারের সদস্যরা। এরপরও মশিয়ার তার শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতেন। তবে ওই গৃহবধুকে হত্যার অভিযোগ এনে দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে এলাকাবাসী দক্ষিন গজালিয়া গ্রামে এক মানববন্ধন কর্মসুচি পালন করে। এরপরও থানায় গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ।
সূত্রটি আরো জানায়, বাপের বাড়িতে অবস্থান করাকালিন গত ১১ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙা গ্রামের অসুস্থ শ্বশুড়িকে দেখতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কৈয়াসিটিবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে শ্যালিকাকে একটি মাইক্রোবাসে তোলে মশিয়ার। পরে তাকে কাটাবুনিয়ার একটি বাড়িতে তুলে ১৩ এপ্রিল রাত ৮টা পর্যন্ত কয়েকবার ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার নাম করে ও তাকে বড় বোনের পরিণতি করে দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়। সেখান থেকে পালিয়ে ১৩ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে বাড়ি ফেরে মশিয়ারের শ্যালিকা। বেগতিক বুঝে নিজেদেরকে হত্যা মামলা থেকে বাঁচাতে ১৫ এপ্রিল পাইকগাছা প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলন করেন মশিয়ারের বাবা কামরুল ইসলাম। স্বাভাবিক হওয়ার পর মেয়ের কাছে বিস্তারিত ঘটনা শুনে বাবা বাদি হয়ে মশিয়ারের নাম উল্লেখ করে ২০ এপ্রিল পাইকগাছা থানায় পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮(১), ৮(২) ও ৮(৩) ধারা তৎসহ ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধিত ২০০৩ এর ৭ ও ৯(১) ধারায় জিআর-১০৭ নং মামলা দায়ের করেন। ওইদিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
সরেজমিনে বুধবার সকালে কালুয়া গ্রামে গেলে মোমেনা খাতুন, আনোয়ারা খাতুন ও রহিমা খাতুন জানান, তাদের গ্রামের মশিয়ার রহমানের স্ত্রী ও ভাটা শ্রমিকের বড় মেয়ের লাশ দাফন করানোর সময় তার বুকের বাম পাজরে, মুখমণ্ডলের বাম পাশে ও বাম হাতের পাঁচটি নখে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মর্মে কালো দাগ সম্বলিত দাগ তার দেখেছেন। নিহতের জিহবা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে আটকে ছিল বলেও জানান তারা।
একইভাবে গ্রাম ডাক্তার রবিউল ইসলাম ও আব্দুস সালাম জানান, তাদেরকে যখন ডাকা হয়েছিল শীতকাল হলেও টিউবওয়লের নীচে শুইয়ে রাখা মৃত মেয়ের শরীরে তাপ ছিল। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলন তারা।
কালুয়া গ্রামের পলাতক কামরুল ইসলাম সরদার জানান, পুত্রবধুকে হত্যার দায়ে তাকেসহ পাঁচজনের নামে মামলা করা হয়েছে মর্মে তিনি । পুত্রবধু আত্মহত্যা করেছিল বলে দাবি করেন তিনি।
ধর্ষণ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শহীদ হোসেন জানান, মশিয়ার রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন করা হয়। আদালত তিন দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করলে তাকে সোমবার জেলখানা থেকে পাইকগাছা থানায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার দুপুরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
পাইকগাছা আদালতের আইনজীবী অ্যাড.সুরেশ চন্দ্র রায় থানা মামলা না নেওয়ায় ও করোনা পরিস্তিতির কারণে দেরীতে মামলা দায়েরর কথা উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম পলাশ কুমার দালাল ভাটা শ্রমিকের মেয়েকে হত্যার অভিযোগটি আমলে নিয়ে মঙ্গলবার সেটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ এজাজ শফি ভাটা শ্রমিকের মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় কোন এজাহার দায়ের করা হয়নি দাবি করে বলেন, আদালতের নির্দেশ পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই ওই ভাটা শ্রমিকের দায়েরকৃত মামলাটি ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় রেকর্ড করে তদন্তভার উপপরিদর্শক তরুণ কুমার দত্ত এর উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
উপপরিদর্শক তরুণ কুমার দত্ত জানান, বুধবার দুপুরে তিনি মামলার কাগজপত্র হাতে পেয়েছেন। ময়না তদন্তের জন্য বৃহষ্পতিবার কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে আবেদন জানাবেন। একই সাথে শালিকার ধর্ষণ মামলায় জেল হাজতে থাকা মশিয়ার রহমানকে স্ত্রী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানানো হবে।