শুক্রবার ● ২৮ মে ২০২১
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন: এ গৌরব দেশবাসীর
ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন: এ গৌরব দেশবাসীর
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা যখন আমের বাজারজাতকরণ নিয়ে চিন্তিত ঠিক তখনই চালু হলো ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন। বিশেষ লকডাউন চলমান অবস্থায় করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চালু হলো এ ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনটি। গত ২৭ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এ ট্রেনটির উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা সহজেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন যায়গায় আম পৌঁছাতে পারবেন। নামমাত্র খরচে ঢাকায় আম পৌঁছাতে পেরে আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা আনন্দিত।
এ বছর তেমন ঝড় না থাকায় আমের কোন ক্ষতি হয়নি। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার তীব্র খরায় ৩০ শতাংশ আমের গুটি ঝরে যায়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এ বছর আম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আছে পোনে তিন লাখ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আম সংগ্রহ করতে পারলে এবার আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও এবার রাজশাহী ও নঁওগায় আমের ফলন ভালো হয়েছে। ফলে দেশে পুরোপুরি আমের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
রাজশাহী অঞ্চলের আম যেন সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে সে উদ্দেশ্যেই ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের যাত্রা। যেখানে কুরিয়ার সার্ভিসের মধ্যেমে কেজি প্রতি বারো থেকে পনেরো টাকা খরচ হবে সেখানে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা নামমাত্র ১ টাকা ৩০ পয়সা খরচ করে সহজেই ঢাকা পৌঁছাতে পারবে। ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনটি প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বিকেল ৪ টায় ছেড়ে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছবে ৫টা ২০ মিনিটে। এখানে ৩০ মিনিট বিরতির পর ৫টা ৫০ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুর করবে। রাজশাহী অঞ্চলের ১০টি এলাকা থেকে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে কৃষকরা আম ছাড়াও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য পাঠাতে পারবে।
করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাধারণ মানুষের চেয়ে আম পরিবহনে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েন জেলার ৩০ হাজার বাগান মালিক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টজনরা। দেশের সাথে সড়ক ও রেল পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সর্বত্র লকডাউন কার্যকর থাকলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলছে বিশেষ লকডাউন। ফলে সব ধরণের পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এতে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে সহজে আসতে পারছে না। তারপরও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের মিষ্টতা ও নামের জন্য সকল বাধা উপেক্ষা করে অনেক ব্যবসায়ী বিভিন্ন মাধ্যমে আমের চাহিদা পাঠাচ্ছে। এমন সময় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের উদ্বোধন সত্যি আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আগমন করেছে।
আমের মৌসুম শুরু হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ী, আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের মাধ্যমে ক্রেতারা আম সংগ্রহ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিক্ষর্থীরা এ সুযোগে বা কাজে অংশগ্রহণ করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে আম পৌঁছে থাকে। বর্তমানে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শির্ক্ষীরা এখন তাদের নিজ বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থান করছে। ফলে তারা ভালোভাবেই আমের অর্ডার নিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাগানের তাজা আম পৌঁছে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
রেলওয়ে কর্তপক্ষের মাধ্যমে জানা যায় ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৩৪৩ কেজি আম দেশের বিভিন্ন যায়গায় পৌঁছানো যাবে। যেখানে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই সড়ক পথে দৈনিক দেড় হাজার টন আম পাঠানো হয় সেখানে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলের আম পরিবহন একেবারেই অল্প। আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনে পরিবহনের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। দেশের সর্বত্র আম পৌঁছাতে এ সময়ে অতিরিক্ত ট্রেন চালু করা দরকার।
বাগান থেকে সংগ্রহ করে কয়েক হাত বদলে আম পরিবহনে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে বলে আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। তারপরেও নিরাপদে পৌঁছবে বলে তারা স্বস্তিতে থাকতে পারছে। আম উঠানো বা নামানোর সময় যেন আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে। কোন কারণে আমে আঘাত লাগলে পঁচে বা নষ্ট হতে পারে। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সুনাম নষ্ট হবে।
সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এখন করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর হটস্পট। শিবগঞ্জ ভারতের পাশ্ববর্তী হওয়ায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। আবার আমের সবচেয়ে বড় বাজার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট। আমের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ যেন সারাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ট্রাক ড্রাইভার, আম পাড়ায় নিয়োজিত শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যেন সংক্রমণ ছড়াতে না পারে সেজন্য স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম মানতে হবে। বাগানে আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ থেকে শুরু করে সর্বাবস্থায় কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কঠোর লকডাউনের মধ্যে থাকলেও আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ এর আওতামুক্ত। তাই সহজেই ট্রাকে বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম বাজারজাত করা যাচ্ছে। ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের জন্য বাড়তি পওয়া। তবে ট্রেনে পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি বা ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষিরা খুব সহজেই সারাদেশে বাগানের তাজা আম উপহার দিতে পারবে। যেহেতু চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান অর্থকারি ফসল আম, তাই এখানে অতিরিক্ত বিশেষ ট্রেন কিংবা অন্য মাধ্যম সরকারিভাবে চালু করা প্রয়োজন। আম পরিবহনে রাস্তা যেন চাঁদাবাজমুক্ত হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে।
সবচেয়ে মিষ্টি ফল পেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ গর্বিত। বিভিন্ন মাধ্যমে এ ফল খেতে পেরে দেশের মানুষও গর্ব করে। হিমসাগর, খিরসা থেকে শুরু করে আশ্বিনার মতো দেশীয় ফল খেতে পেরে আমরা সহজেই ফলের চাহিদা মেটাতে পারছি। গত বছরের ন্যায় এবারও সরকারিভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের যাত্রা সত্যি গৌরব ও প্রশংসার দাবিদার। এজন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ নিশ্চয় কৃতজ্ঞ। ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে শুধু ঢাকা-টাঙ্গাইলই নয় আম যেন সারা দেশেই ছড়িয়ে যায় সে প্রত্যাশা এখন শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিদের নয় বরং সমগ্র দেশবাসীর। আরো সহজে কীভাবে সারাদেশের চাহিদা মিটিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুমিষ্ট আম পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রপ্তানী করা যায় তা এখন ভাবার সময় হয়েছে।
লেখক: শাহাদাত আনসারী
[ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক]