রবিবার ● ৪ জুলাই ২০২১
প্রথম পাতা » উপকূল » ইয়াসের একমাস অতিবাহিত হলেও ঘরে ফেরা হলোনা কয়রার গাঁতীরঘেরীর গৃহহীনদের
ইয়াসের একমাস অতিবাহিত হলেও ঘরে ফেরা হলোনা কয়রার গাঁতীরঘেরীর গৃহহীনদের
রামপ্রসাদ সরদার, কয়রা, খুলনাঃ
ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও ঘরে ফেরা হয়নি খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাঁতীরঘেরী গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের। ঘর-বাড়ী হারিয়ে তারা নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামের উঁচু রাস্তার উপরে ঝুপড়ি বেঁধে মানবেতর জীবন-যাপন করছে আজ ৩৮ দিন।
হরিহরপুর গ্রামের উঁচু রাস্তার উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছেন গাঁতীরঘেরী গ্রামের অলোকা রাণী। তিনি বলেন, ইয়াসের দিন সকল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। সাথে ছিল হালকা দমকা হাওয়া। দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। নদীতে তখন জোয়ার এসেছিলো। তখনো রান্না-বান্না শেষ হয়নি। রাস্তায় চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দেখি রাস্তা ছাপিয়ে জল ঢুকিতছিল। তাড়াহুড়ো করে সকলে মিলে যার যার বাড়ীর সামনে মাটি দিয়ে জল ছাপানো আটকানোর চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের চেষ্টা বৃথা হয়ে গেল। রাস্তার বিভিন্ন যায়গা দিয়ে জল ছাপাতে ছাপাতে জোয়ারের প্রবল চাপে কয়েক যায়গা দিয়ে রাস্তা ভেঙ্গে প্রবল বেগে জল ঢুকে আমাদের ঘর-বাড়ী সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রান্না করা ভাত দুপুরে আর খাওয়া হলোনা। আমাদের আর কিছু রইলোনা। ঘর-বাড়ী হারিয়ে রাস্তার উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করতে হচ্ছে।
তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে আরো বলেন, যেটুকু যায়গা জমি ছিল এর আগের আইলার তাণ্ডবে তা ভেঙ্গে নদীতে চলে গেছে। কয়েক মাস আগে তিনকাঠা জমি কিনে ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেছিলাম কয়েকদিন আগে। সেই ঘরে একমাসও বাস করতে পারলামনা। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল এবারের জলোচ্ছ্বাসে। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে যে কোথায় যাবো ঈশ্বরই জানেন।
একই গ্রামের শেফালী দাসও ঐ উঁচু রাস্তার উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছেন। তিনিও বলেন, শাকবাড়ীয়া নদীর রাস্তা ভেঙ্গে মুহুর্তেই তার ঘরে জল ঢুকে। তার কোলের ছোট্ট শিশুকেও দুপুরে খেতে দিতি পারেননি সেদিন। তাড়াহুড়ো করে রাস্তার উপরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চোখের সামনে তার ঘর-বাড়ী সহ গ্রামের সকলের ঘর-বাড়ী ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে সর্বশান্ত তপন মণ্ডল জানান, সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে ও দিনমজুরির কাজ করে তার সংসার চলতো। সবকিছু হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার কাঁকড়া ধরা নৌকায়। ৫দিন নৌকায় থাকার পরে বেড়িবাঁধে ঝুপড়ী বেঁধে খেয়ে না খেয়ে চলছে তার সংসার।
অলোকা রাণী, শেফালী দাস ও তপনের মত সর্বস্ব হারিয়ে উপজেলার উত্তর বেদকাশীর গাঁতীরঘেরীর বেড়িবাঁধ ও হরিহরপুরের উঁচু রাস্তার উপরে আশ্রয় নিয়েছে ৬০/৭০ টি পরিবার। ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে খুলনার কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১২টি পয়েন্ট ভেঙ্গে প্লাবিত হয় অর্ধশতাধিক গ্রাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাকবাড়ীয়া নদীর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে গাঁতীরঘেরী এলাকা। এভাবে প্রতিদিন ২ বার জোয়ার ভাটার খেলা চলছে। ইয়াসের দিন থেকে ঘর-বাড়ী হারিয়ে রাস্তার উপরে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই গ্রামের মানুষ।
উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা যায়, গত ২৬ মে ইয়াসের তাণ্ডবে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের ৫০ টি গ্রাম। ঘুর্ণিঝড় ও পূর্ণিমার অতিমাত্রায় জোয়ারের প্রবল স্রোতের চাপে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়ীয়া নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয় প্লাবিত হয়। বিদ্ধস্ত হয়েছে ১২৫০ টি ঘর। তলিয়ে গেছে ২ হাজার ৫০০ টি চিংড়ি মাছের ঘের। যার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা এবং ১৫ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে যারা ঘর-বাড়ী হারিয়ে রাস্তার উপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছেন তাদের জন্য সরকারী ও বেসরকারী ভাবে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। গাঁতীরঘেরীর শাকবাড়ীয়া নদীর ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা ঘরে ফিরতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।