রবিবার ● ১১ জুলাই ২০২১
প্রথম পাতা » মিডিয়া » সময়ের মহাসড়কে উপকূল সাংবাদিকতা
সময়ের মহাসড়কে উপকূল সাংবাদিকতা
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
সময়ের পরিক্রমায় উপকূল সাংবাদিকতার গুরুত্ব বাড়ছে। উপকূল অঞ্চলকে ফোকাস করে যে সাংবাদিকতা, সেটাকেই বলা হচ্ছে উপকূল সাংবাদিকতা। এরমধ্যে উপকূলের পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়সহ বহুমূখী দুর্যোগ, মানুষের অধিকারসহ নানান ধরণের বিষয় আছে। আছে বৃহৎ সম্ভাবনার ক্ষেত্র, নাগরিক সেবা, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাসহ নানান ধরণের বিষয়। উপকূল অধ্যুষিত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উপকূলের সাংবাদিকতা প্রসারের উদ্যোগ খুবই যুক্তিসঙ্গত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপকূল অঞ্চল কিংবা পরিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র প্রসারের দৃষ্টান্ত আছে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে কোস্টাল জার্নালিজম, আছে আইল্যান্ড জার্নালিজম, আছে ওশান জার্নালিজম, আছে মেরিন জার্নালিজম। তবে দুনিয়া জুড়ে এইসব’ দৃষ্টান্তের সাথে তুলনামূলক ভাবে বাংলাদেশে উপকূল অঞ্চল নিয়ে সাংবাদিকতা সেভাবে এগোয়নি। আমাদের দেশে পরিবেশ সাংবাদিকতা, দূর্যোগ সাংবাদিকতা, ক্রীড়া সাংবাদিকতা, বিনোদন সাংবাদিকতা, কৃষি সাংবাদিকতা, অর্থনীতি সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্র রয়েছে। সে হিসাবে উপকূল সাংবাদিকতার গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। তবে কেন উপকূল সাংবাদিকতার প্রয়োজন। তার জন্য আগে উপকূল সম্পর্কে জানা দরকার। যেখানে ভূমি সুমদ্রের সাথে মিলিত হয় এমন এলাকাই উপকূল। সমুদ্র ও স্থল ভাগের সংযোগস্থলকে সাধারণ ভাবে উপকূল বলা হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে উপকূলের আকৃতি ও গঠন সর্বত্র সমান নয়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের উপকূল দেখা যায়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তের কারণে ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা দূর্যোগ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের খবরের গুরুত্ব কোন অংশে কম না। শুধু সংকট নয়, সমস্যা-সম্ভাবনার অনেক খবর আছে সেখানে। এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জন কিংবা ডেল্টাপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে উপকূলের জন্য সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ন হয়ে পড়েছে।
হিমালয়ের বিশাল জলরাশি নদীর সুদীর্ঘ গতিপথে বয়ে আনা পলি বঙ্গোপসাগরের মোহনা অঞ্চলে বহুকাল ধরে সঞ্চিত হয়ে বাংলা অক্ষর ব এর আকারে সুবিশাল যে ভূমিরূপ গঠিত হয়েছে, তা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মিলিত কার্যের ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। যা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল। উপকূল হচ্ছে সমুদ্র,নদী প্রভৃতির কূলের নিকটবর্তী স্থান; বেলাভূমি, তটভূমি। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ ক্রান্তিরেখা বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ২১-২৩ক্ক উত্তর ও ৮৯-৯৩ক্ক পূর্ব অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। দেশের ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলা প্রকৃতিগত ভাবেই উপকূল এলাকা। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলটি তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত পূর্ব অঞ্চল, মধ্য অঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল, যার বিস্তৃতি ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার, সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা মিলে ২৭৫ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত, এই বিস্তৃত ভূমিতে প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। উপকূলের ছেড়া দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পতেঙ্গা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, চরকুকরী মুকরী, ঢাল চর, মনপুরা, চর নিজাম, কুয়াকাটা, হিরণ পয়েন্ট, বৃহৎ সুন্দরবনসহ উপকূলীয় চরাঞ্চল পরিকল্পিত উপায়ে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ- তেল, গ্যাস, গন্ধকসহ লবণ, মাছসহ বিভিন্ন ফসল তো রয়েছেই।
বঙ্গোপসাগরের জোয়ার ভাটার প্রভাব নোনা পানির অনুপ্রবেশ এবং ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, এই ধরণের প্রভাব বলয় যুক্ত ১৯টি জেলা উপকূলীয় ভূমি হিসাবে অন্তভূক্ত। এর মধ্যে উপকূলীয় ১৪৭টি উপজেলার মধ্যে ৪৮টি উপজেলা নানান প্রাকৃতিক কারণে ঝুকিপূর্ণ। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূল অঞ্চলে ঘনঘন ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ওঠা, জোয়ারের দীর্ঘ স্থায়িত্ব, নদী ভাঙন, মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে ১৪৭টি উপজেলার উন্নয়নে টেকসই উপকূল গড়ে তোলা জরুরি। দেশের ২৫ শতাংশ নাগরিক যেমন উপকূলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি ২৫ শতাংশ অবদান রয়েছে উপকূলের। বাংলাদেশের উপকূলাঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। উপকূল এলাকা সংকট ও সম্ভাবনার অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। এখানে ঘূর্ণিঝড়, জলেচ্ছাস ও নদী ভাংগন এর মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ এ ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনি অর্থনৈতিক সম্ভবনা ও রয়েছে প্রচুর।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় উপকূল সাংবাদিকতা। তবে উপকূল খুব অবহেলিত একটি অংশ। দুর্যোগের সময়কাল ছাড়া উপকূলের প্রতিবেদন মিডিয়াতে খুব বেশি স্থান পায় না। স্থান পেলেও তার গুরুত্ব থাকে খুব কম।
তবে সময়ের ব্যবধানে উপকূলের নোনা জল, কাদামাটি মাড়িয়ে উপকূলের সংবাদ সময়ের মহাসড়কে ছুটে চলেছে। উপকূলের গুরুত্ব বাড়ছে। তাই উপকূলের এবং ঢাকার অনেক সাংবাদিক উপকূল ইস্যুতে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন৷ আগের চেয়ে এই ইস্যুটির অনেক বেশি গ্রহনযোগ্যতা বেড়েছে মিডিয়া হাউসগুলোতে৷ উপকূল সাংবাদিকতার আলাদা মূল্য আছে বলেই সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম জগতের প্রাণের প্রতিষ্ঠান প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এই বিষয়ে সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। উপকূলের সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি পেল উপকূল সাংবাদিকতা। এই পথ ধরে উপকূল সাংবাদিকতা এগিয়ে যাবে অনেক দূর।
পিআইবি’র এই উদ্যোগের ফলে উপকূলের ইস্যুতে সাংবাদিকদের ধারণা আরো পাকাপোক্ত হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে ধারণা বিস্তৃত হবে। সাংবাদিকেরা উপকূল ইস্যুতে আরো বেশি করে গ্রাউন্ড স্টোরি করার সুযোগ পাবেন। সংবাদ মাধ্যমের হাত ধরে এভাবে এগোবে উপকূল৷ আর উপকূল এগোলে দেশ এগোবে।
লেখকঃ সাংবাদিক