বৃহস্পতিবার ● ২২ জুলাই ২০২১
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নাম বাংলাদেশের উপকূল। যেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূল অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষা নির্বাহ করে উপকূলীয় বেড়ীবাঁধের উপরে। দূর্যোগে এই বাঁধ তাদের ভরসার একমাত্র স্থল। বাঁধ ভালো থাকলে তারা দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে।আর বাঁধ ভেঙ্গে গেলে তাদের ঘরবাড়ী, ফসলের ক্ষেত, রাস্তাসহ সবকিছু পানিতে ভেসে যায়। মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
হিমালয়ের বিশাল জলরাশি নদীর সুদীর্ঘ গতিপথে বয়ে আনা পলি বঙ্গোপসাগরের মোহনা অঞ্চলে বহুকাল ধরে সঞ্চিত হয়ে বাংলা অক্ষর ব এর আকারে সুবিশাল যে ভূমিরূপ গঠিত হয়েছে, তা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মিলিত কার্যের ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। যা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চল। প্রায় ৬ হাজার ৫শ বছর পূর্বে বঙ্গোপসাগর উপকূলে সুন্দরবন বলে কিছু ছিল না। বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে কোথাও ১শ কিলোমিটার কোথাও ৩শ কিলোমিটার অবধি স্তলভাগ সমুদ্র ছিল। ব-দ্বীপের উপর বেড়ে উঠা সুন্দরবন বয়সে নবীন। প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে সন্দরবন গড়ে উঠেছে। সে কারণে উপকূলের ভুমি গঠন দূর্বল, নিচু ও নরম। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ বার বার উপকূলে আঘাত হানায় ক্ষতি পরিমাণ বাড়ছে।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলটি তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। পূর্ব অঞ্চল, কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল। গঙ্গার জোয়ার সমভূমি হিসাবে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলটি আধা-সক্রিয় ব-দ্বীপ নিয়ে গঠিত এবং বহু চ্যানেল এবং খাঁড়ি দ্বারা ক্রস করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি সক্রিয়তা এবং ক্ষয়ের সবচেয়ে সক্রিয় এবং ক্রমাগত প্রক্রিয়া। এই অঞ্চলটিতে মেঘনা নদীর মোহনা অবস্থিত। পূর্ব অঞ্চলটি পাহাড়ী অঞ্চল দ্বারা আচ্ছাদিত, যা আরও স্থিতিশীল। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল যা জঙ্গল, সমতলসহ বিভিন্ন পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইন্টারফেসের সমন্বয়ে গঠিত। প্রায় ৭০টি দ্বীপ, জমি, সৈকত, একটি উপদ্বীপ, পল্লী জনবসতি, নগর ও শিল্প অঞ্চল এবং বন্দর নিয়ে গঠিত উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই দরিদ্র এবং সমগ্র জনগণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট বিপদ উভয়েরই সংস্পর্শে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, ভারী বৃষ্টিপাত, উপকূলীয় জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা এবং নদী ভাঙ্গন প্রধান প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় অষ্টমাসি বাঁধ ব্যবস্থা চালু ছিল।দিন রাত ২৪ ঘণ্টায় দুইবার জোয়ার দুইবার ভাটা হয়। জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ি ও ফসলের ক্ষেত লবন পানিতে প্লাবিত হয়ে নস্ট হয়ে যেত। সে কারণে বন পরিষ্কার করে বসতি ও জমির চারপাশে এসব বাঁধ দেওয়া হতো। শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণপানি প্রবেশ ঠেকানোও ছিল এমন বাঁধের বড় উদ্দেশ্য। কারণ জমিতে লবণপানি প্রবেশ করলে ফসল নষ্ট হত আর সেখানে আবার সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি জন্মাত। সেই ভয় থেকে পরিত্রাণের জন্য বছরে আট মাস টিকে থাকে এমন বাঁধ নির্মিত হতো। মাটির তৈরি বাঁধ এই অঞ্চলে কৃষি কাজে সুরক্ষা দিত।যা অষ্টমাসি বাঁধ নামে পরিচিত ছিল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারী প্রথার অবসান হওয়ার সাথে সাথে অষ্টমাসি বাঁধ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে। কেননা জমিদারদের কর্মচারীরা গ্রামের সাধারণ জনগণ ও কৃষকদের সংগঠিত করে ঐ বাঁধগুলো নির্মাণ করতেন।
১৯৫৪-৫৫ সালে উপকূলসহ সারা দেশে ব্যাপক বন্যা হয়। এ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বব্যাংক ও নেদারল্যান্ডসের প্রকৌশলীদের পরামর্শে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে উপকূল জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় জেলাসমূহসমুদ্র উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্প (সিইপি) ভুক্ত। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালি, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট জেলার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সমুদ্র উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প বা সিইপি। বাঁধনির্মাণ এবং পানি নিষ্কাশনে এই প্রকল্পে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্লুইস গেইট বা জলকপাট দ্বারা। সেই সঙ্গে পানি অপসারণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাও এখানে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বন্যা এবং লবণাক্ত পানির অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে এটি ব্যাপক ও কার্যকর পরিকল্পনা হিসেবে চিহ্নিত। প্রকল্পটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে দুই পর্বে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম পর্বে প্রকল্পভুক্ত ছিল ৯২টি পোল্ডার নির্মাণ, যার মাধ্যমে ১০ লক্ষ হেক্টর ভূমি প্রকল্প সুবিধার আওতায় আসে। পোল্ডার একটি ডাস শব্দ, যার অর্থ বন্যা নিরোধের জন্য নির্মিত মাটির দীর্ঘ বাঁধ (ডাইক) দ্বারা বেষ্টিত এলাকা। দ্বিতীয় পর্বে ১৬টি পোল্ডারে আরও চার লক্ষ হেক্টর ভূমি উদ্ধার সম্ভব হয়। সিইপির আওতায় এ পর্যন্ত ৪,০০০ কিমি-এর অধিক দীর্ঘ বেড়িবাঁধ এবং ১,০৩৯টি নিষ্কাশন জলকপাট বা স্লুইস গেইট নির্মিত হয়। সব ধরনের ডাইককে বেড়িবাঁধ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমুদ্র ডাইকগুলো মূলত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকায় সমুদ্রের মুখে অথবা প্রশস্ত নদীগুলির তীরে অবস্থিত। এসব স্থানে উঁচু ঢেউরাজি মোকাবেলায় এই বাঁধগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি এ সকল বাঁধ সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গতিশীলতার সঞ্চার করেছে। বেড়িবাঁধ জোয়ার প্লাবন থেকে ভূমিকে রক্ষা করতে কার্যকর, কিন্তু বাঁধের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়া জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ার জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে না। এই বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রথম দিকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধও তৈরি হয়। উপকূলে বাড়তে থাকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। তবে বারবার দুর্যোগ-দুর্বিপাক আঘাত হানে । ১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০২১সালে ইয়াস পর্যন্ত সময়ের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট ৪৮৫ বার মাঝারি ও বড় জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ৫০ বছরে ১৫৮ টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে সুন্দরবনও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি সবচেয়ে ক্ষতির শিকার। ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভবিষ্যতে আরও ঘন এবং তীব্র হবে। ভৌগোলিক পরিস্থিতি, ঘন জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ুর দুর্বলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ পশ্চিমাংশটি বেশিরভাগ সুন্দরবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে তবে এটি নিচু ভূমির অঞ্চল, অন্যান্য কেন্দ্রীয় অংশটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আরও গতিশীল অংশ। আসে সিডর, আইলা, ফণী, বুলবুল, র্নািগস, আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। প্রতি বছরই ঝড়-তুফান ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলবাসীকে তাড়া করে ফেরে। দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল ঘিরে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা-খুলনা-বাগেরহাট উপকূলের ৪২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
৭১০ কিমি উপকূল তিনটি বড় অঞ্চলে বিভক্ত বদ্বীপীয় পূর্বাঞ্চল প্রশান্ত মহাসাগরীয় ধরনের , বদ্বীপীয় কেন্দ্রঅঞ্চল এবং সুস্থিত ব-দ্বীপীয় পশ্চিমাঞ্চল আটলান্টিক মহাসাগরীয় ধরনের । প্রায় ৯,৩৮০ বর্গ কিমি বিস্তৃত উপকূল অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বহু সংখ্যক দ্বীপ, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের ফানেলাকার অংশ। বিপুল পরিমাণ পলি পরিবহণ (বার্ষিক প্রায় ২.৪ দ্ধ ১০৯ মে টন), নিচু ভূমিরূপ ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় সামুদ্রিক ঝড় ইত্যাদি হলো এ উপকূলীয় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। প্রায় উপকূলের প্রাকৃতিক সম্পদ দুর্যোগসহ বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশে সমন্বিত উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় পরিবেশগত বিবেচনাগুলির সমন্বয় বিধানের কিছুটা অভাব রয়েছে। উপকূলীয় জমির অবাধ বেসরকারিকরণ পরিবেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। মৎস্যজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি, উপকূলীয় সম্পদের অতিব্যবহার, পানির মানের অবনতি, চিংড়ি ঘের তৈরীর জন্য ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সীমাবদ্ধতা, সামুদ্রিক ঝড় ইত্যাদি। প্রধান সমস্যাগুলির অগ্রাধিকার ভিত্তিক সুরাহা প্রয়োজন।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে মতে, বাংলাদেশের ১৯ জেলার ১৪৭ উপজেলার ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এ জনপদে বসবাস করেন প্রায় ৫ কোটি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অরক্ষিত অবস্থায় জীবনধারণে বাধ্য হন তারা। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষ তাদের বসতভিটা ও কৃষিজমি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হন। ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস বারবার আঘাত হানার কারণে সড়ক অবকাঠামো, বসতবাড়ি, কৃষিজমি বিনষ্ট হয়। এসব জমির উর্বরতাশক্তিও হারিয়ে যায় অতিরিক্ত লবণাক্ততায়। ফলে ফসল উৎপাদনও হ্রাস পায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত বেড়িবাঁধগুলো বছরের পর বছর মেরামতহীন থাকাসহ পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে অরক্ষিত উপকূলীয় বাসিন্দাদের জীবন কাটে সীমাহীন ঝুঁকিতে। উপকূলীয় বাসিন্দাদের সুরক্ষিত রাখতে সরকার শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তাদের ঝুঁকিমুক্ত জীবন নিশ্চিত হচ্ছে না । প্রশাসন ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী দেশের ৩৩ উপজেলাকে সাগর-সংলগ্ন বিপৎসংকুল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার। এসব উপজেলায় পরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম না হওয়ায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন এখনো। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাসমূহে এখনো নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। বছরের পর বছর ধরে বেড়িবাঁধগুলোও পুরোপুরি মেরামত বা সংস্কার করা হয়নি। ফলে এখনো উপকূলবাসী অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরোনো। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। উপরন্তু চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে লবণপানি ঢোকানোর জন্য যত্রতত্র বাঁধের ভেতরে ছিদ্র করা বা পাইপ বসানোর ফলে এগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ফলে পোল্ডারগুলোর অস্বাভাবিক জোয়ার কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। উপকূলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চল জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষ ছয় থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত বাঁধ উঁচু করলে বাঁধ টেকসই হবে। এলাকার বেশির ভাগ বাঁধই ব্যবহারের অনুপযোগী। সেখানে নতুন করে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। আগের জীর্ণ বাঁধের ওপর আবার বাঁধ বানালে তা টেকসই হবে না। আধুনিক কারিগরি জ্ঞান আর কৌশল নিয়ে বাঁধগুলো সুদৃঢ় করা দরকার। ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডর আম্ফানের পর যে বাঁধগুলো সুদৃঢ় করা হয়েছে, সেসব সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেশি সুরক্ষা দিয়েছে। বাঁধগুলো পুনর্নিমাণের সময় সর্বাধুনিক এবং যথেষ্ট চওড়া ও বেশি সংখ্যায় জলকপাট রাখতে হবে। উপকূলের বহু অঞ্চলে জলকপাটগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জলকপাটগুলো সচল রাখার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিত পর্যাপ্ত সংখ্যায় খালাসি নিয়োগ দেওয়া। পোল্ডারের ভেতরের মৃতপ্রায় নদী, খাল, বিল ইত্যাদি পুনঃখনন করে সচল করা দরকার, যাতে বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধ পরিস্থিতি না হয়। নদী ও খালে মাছ চাষের জন্য সব বাধা উচ্ছেদ করে সারা বছর সেসব সচল রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। উপকূলীয় বাঁধগুলো টেকসই এবং নির্মাণ কাজে যথাযথ তদারকি করলে এ বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। উপকূলীয়,চরাঞ্চল ও দ্বীপের মানুষের জীবন ও জীবিকার গতিপথ ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ নাগরিক উপকূলে বসবাস করে। জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি ২৫ শতাংশ অবদান উপকূলের।বাংলাদেশের উপকূলাঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। উপকূলের বহুবিচিত্র ব্যবহারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কক্সবাজারের ১৪৫ কিমি দীর্ঘ আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত , নৌবাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ, পর্যটন, জাহাজ ভাঙা, তেল ও গ্যাস সন্ধান ইত্যাদি। অফুরন্ত সম্ভাবনা ভরা উপকূল। তেমনি সমস্যা ও সংকট যেমন রয়েছে; নদ-নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ শাসন প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক রাখতে পারলে উপকূল অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতিতে আরো বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হতো।আর টেকসই বেড়িবাঁধই পারে উপকূলীয় এলাকা সুরক্ষিত রাখতে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উপকূল হবে সমৃদ্ধ।
লেখকঃ সাংবাদিক।