মঙ্গলবার ● ১০ আগস্ট ২০২১
প্রথম পাতা » অপরাধ » খুলনায় মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর, পরিদর্শনে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার
খুলনায় মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর, পরিদর্শনে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার
এস ডব্লিউ নিউজ: খুলনার রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের শিয়ালী গ্রামে মৌলবাদী দূর্বৃত্তদের দফায় দফায় হামলায় বেশ কয়েকটি মন্দির ও প্রতিমা এবং বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাংচুর এবং লুটপাটের ঘটনাস্থল পরির্শন করেছেন খুলনাস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার রাজেশ কুমার রায়না।
সোমবার সকালে তিনিসহ হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রাম পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি ঘুরে দেখেন। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাথে কথা বলে তাদের প্রতি সহানুভুতি জানান। এ সময় ক্ষতিগ্রস্থরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বর্বর ও অমানুষিক হামলার বর্ণনা করেন। আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কেউ কেউ।এ সময়ে হামলার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি সহমর্মীতা প্রকাশ করে সহকারী হাইকমিশনার আর.কে রাইনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশ পারষ্পরিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আবহমানকাল ধরে বসবাস করে আসছে। যারা এ ধরনের হামলা ও শান্তি বিনষ্ট করে তারা মানুষের ভারো চায় না। আমি মনে করি শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না।তার বিশ্বাস বাংলাদেশের সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই ন্যাক্কারজনক এই ঘটনার সাথে জড়িত প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন।তিনি পারষ্পারিক সহমর্মিতা ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকলকে সচেতন ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে, রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনার সাথে জড়িত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় রূপসা উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শক্তিপদ বসু বাদি হয়ে ২৫জনের নামোল্লেখসহ ১৫০-২০০জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন।পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত ৯জনসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হল-শরিফুল ইসলাম(৪০), শেখ মঞ্জুরুল আলম(৪২), শরিফুল শেখ(৩০) রানা শেখ(২২), আকরাম ফকির(৪০), সোহেল শেখ(২০), সম্রাট মোল্যা(২৪), জামিল বিশ্বাস(২৪) শামিম শেখ(২২) ও মোমিনুল ইসলাম(২৮)।পরিস্থিতি সামাল দিতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। পুলিশ তৎপরতার কারণে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।শনিবার এ হামলার ঘটনার পর প্রশাসন ও পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহাবুব হাসান জানান, এলাকা এখন শান্ত রয়েছে। নতুন কোন ঘটনা আর না ঘটে সে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।জেলা প্রশাসক মো: মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, রুপসা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি যাতে আর কোনরূপ অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যারাই এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় সনাতন ধর্মালম্বীরা সন্ধ্যারতি করার জন্যে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে শিয়ালী বাজার সংলগ্ন শ্মশান মন্দিরের দিকে যেতে থাকে।এ সময়ে শিয়ালী দাইপাড়া সংলগ্ন জামে মসজিদের কাছে এলে মসজিদের ইমামসহ কয়েকজন যুবক তাদের নাম সংকীর্তন করতে নিষেধ করে। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে বচসা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মালম্বীদের পক্ষ থেকে রূপসা থানায় একটি অভিযোগ করা হয়। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় মৌলবাদীরা শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রথমে শ্মশান মান্দির ও বিগ্রহ ভাংচুর করে। পরবর্তীতে শিয়ালী গ্রামের পার্শবর্তী চাঁদপুর, বামন ডাঙ্গা, গাংনী, নরনীয়াসহ কয়েক গ্রামের বিপুল সংখ্যক লোক সংঘবদ্ধ হয়ে দেশিয় বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দফায় দফায় হামলা চালিয়ে এই ভাংচুর ও লুটপাট করে। দুস্কৃতকারীদের দুই দফার তান্ডবে শিয়ালী বাজার সংলগ্ন শ্মাশান মন্দির ও মন্দিরের বিগ্রহ, গ্রামের পুর্বপাড়ার গোবিন্দ মন্দির, কালি মন্দির, দুর্গা মন্দির, একই এলাকার শিব ধরের গোবিন্দ মন্দিরসহ ৫টি মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর করে। এছাড়াও নিপুল ধরের বাড়ি, শিবনাথ ধরের বাড়ি, নারায়ন, অনিমেশ হিরা ও নিতুল বাড়ই-এর বাড়িসহ ৮থেকে ১০টি ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। একই সময়ে দূবৃর্ত্তরা প্রিতম মেশিনারিজ, গনেশ মল্লিকের ঔষধের দোকান, শ্রীবাস মল্লিকের মুদি দোকান, সৌরভ মল্লিকের মুদি দোকান, অনির্বাণের চায়ের দোকান ভাংচুর করে। এতে বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয় কয়েকজন মহিলা-পুরুষ।রূপসা উপজেলা পুজা পরিষদের সভাপতি শক্তিপদ বসু জানান, হরিনাম সংকীর্তনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মৌলবাদী দুস্কৃতকারীরা শুক্রবার সনাতন ধর্মালম্বী কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনা রূপসা থানাকে জানানো হয়েছিল। তবে পুলিশ কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় শনিবার সংঘবদ্ধ হয়ে মৌলবাদী দুস্কৃতকারীরা দুই দফায় হামলা চালায়। এ সময়ে স্থানীয় ক্যাম্পের পুলিশও নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করতে দেখা গেছে। তারা ৫টি মন্দিরসহ সকল প্রতিমা এবং ১০টি ঘরবাড়ী ও দোকানে হামলা করে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। তাদের হামলায় অন্তত ১০জন নারী-পুরুষ আহত হয়েছে। এসময় শিবনাথ ধরের ঘর থেকে দূর্বৃত্তরা কয়েক লাখ টাকার মালামালও লুট করে বলে শিবনাথের অভিযোগ।রূপসা থানার ওসি সরদার মোশাররফ হোসেন জানান, ইতিমধ্যে ১০জন আসামী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকী আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছেিএলাকায় পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে, রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ তান্ডবে কয়েকটি মন্দির ও প্রতিমা এবং ঘরবাড়ী ও দোকানপাটে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত আটক ও কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়েছে খুলনা জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ। আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবী জানিয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ার, মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস, খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, জেলা আওয়ামীলীগের সবাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ, খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ, খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক এ্যাড. সুজিত অধিকারী, খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী, খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো: আকতারুজ্জামান বাবুসহ নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দিয়েছেন। এছাড়া খুলনা মহানগর যুবলীগের আহবায়ক শফিকুর রহমান পলাশসহ নেতৃবৃন্দ ঘটনার াসথে জড়িতদের গ্রেফতার ও কঠোর মাস্তির দাবী জানিয়েছেন। রবিবার রূপসার শিয়ালী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়ী ও মন্দির পরিদর্শণ শেষে যুবলীগ নেতৃবৃন্দ এ দাবী জানান। এছাড়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সুনাম জেলা কমিটি ও খুলনা জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনার নিন্দা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়েছেন।