শনিবার ● ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » প্রযুক্তি » প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
প্রকাশ ঘোষ বিধান, পাইকগাছা: আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও উন্নত বিশ্বের সাথে সমান তালে এগিয়ে চলেছে। বীজতলা থেকে উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে রয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার।
যে লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হারভেস্টার, ব্রডকাস্ট সিডার পাওয়ার রিপার মেশিন। এমনকি ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষ, বীজ বপন, নিড়ানি, সার দেয়া, কাটা, মাড়াই, ফসল ঝাড়া ও প্যাকেটিং পর্যন্ত সব কিছুই করা হচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। ফলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে, কমছে উৎপাদন ব্যয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফসলের অপচয়ও কম হচ্ছে। ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের।
দেশ যখন স্বাধীন হয়,তখন খাদ্যশস্যের বার্ষিক উৎপাদন ছিল দেড় কোটি টনের মতো। এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কোটি টনের বেশী। এই সময়ে জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে বেড়ে ১৬ কোটিরও বেশী হয়েছে। আবাদী জমির পরিমাণ কমেছে অর্ধেকের বেশী। লক্ষ্য করার বিষয়, আবাদী জমি এত ব্যাপকহারে কমার পরও খাদ্যশস্যের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে, যাতে ১৬ কোটিও বেশী মানুষের খাদ্যসংস্থান হচ্ছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার একেবারে কাছাকাছি এসে উপনীত হয়েছে। এই সাফল্য অর্জনের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি। আর এসব প্রযুক্তির বেশির ভাগই দেশে উদ্ভাবিত।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট আবাদী জমির ৯০-৯২ শতাংশে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। জমি তৈরি থেকে চাল উৎপাদন পর্যন্ত সকল পর্যায় যন্ত্রপাতের ব্যবহার হচ্ছে। পাওয়ার টিলার ব্যবহারকারী পাইকগাছা উপজেলার মটবাটি গ্রামের কবির হোসেন জানান, যন্ত্রটি তিন বছর ধরে ব্যবহার করছি। নিজের জমি চাষ করাসহ অন্যের জমি চাষ করে যন্তের কেনা খরচ উঠে গেছে। এতে কৃষকরা সময় মত চাষাবাদ করে ফসল ফলানোয় সহজ হচ্ছে এবং সেও লাভবান হচ্ছে।
পাইকগাছার কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উপকূলের এ উপজেলায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে এবং বছর বছর বাড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটছে কৃষিতে। দেশের কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার অনেক আগে শুরু হয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে, ট্রাকটর, পাওয়ার ট্রিলার, সেচ মেশিন, রাইস মিল প্রভুতি। এসবের সাথে সম্প্রতি রোপণ, নিড়ানি, মাড়াই, বস্তাবন্দি করার যন্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে। আরও বাড়ানোর জন্য চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষিযন্ত্র আমদানির জন্য। আমদানি শুল্কও রেয়াত করা হয়েছে। ফলে কৃষিতে যান্ত্রিকরণ আরও বাড়বে। যান্ত্রিকরণের এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্বল্প দিনের মধ্যেই দেশের কৃষি সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিকরণ হয়ে যাবে।
কৃষিতে যান্ত্রিকরণ বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে,যা খুব ভালো লক্ষণ। গত অর্ধযুগ ধরে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের কৃষি ভাবনার এক বাস্তব প্রতিফলন। বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরও গতিশীল হয়েছে। খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ২৫% কম মূল্যে ৩৫টি জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৪টি বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তাছাড়া বিএআরআই এবং বিআরআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মোট মূল্যের ৫০% পর্যন্ত ভর্তুকি মূল্যে কৃষকের নিকট সরবরাহ করে যাচ্ছে।
ফসল উৎপাদনে সেচ, সার ও কীটনাশক ও নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন। আর বোরো ধান সেচ, সার ও কীটনাশক নির্ভর। ফলে এর জন্য নিবিড় পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। এতে খরচও বৃদ্ধি পায়। প্রতি বিঘা জমিতে বীজতলা তৈরি, চারা লাগানো, নিড়ানি দেয়া, ধান কাটা ও মাড়াইসহ ঘরে তোলা পর্যন্ত ২৫ জনমত কৃষি শ্রমিক লাগে। ফসল কাটা ও ফসল বপনের সময় শ্রমের যে মজুরি কৃষককে গুণতে হয় তাতে যন্ত্র ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে বোয়ালিয়া বীজ উৎপাদন খামারের সিনিয়র সহকারি পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হারুন বলেন, খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি সময় ও শ্রম সাশ্রয় হয়। কৃষিকাজে শ্রম ও সময়নির্ভর কাজ হচ্ছে চারা রোপণ, বীজ বপন ও ফসল কর্তন। দূর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশের উপকূল এলাকার কৃষিকাজ সব সময় ঝুঁকিতে থাকে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে ফলে সময় মত ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ করা যায়।
কৃষিযন্ত্রপাতি এখনো ভারি শিল্পের অংশ। এখন সরকার কৃষিযন্ত্রপাতিতে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়। প্রয়োজনে এই ভর্তুকি আরো বাড়াতে হবে। কৃষিশ্রমিকের অভাব দিন দিন বাড়ছে। এখন শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত। ২০৩০ সাল নাগাদ তা ২০ শতাংশে নামবে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষি কাজ সহজ ও লাভজনক হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে।