শুক্রবার ● ১২ নভেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » জগতজননী দেবী জগদ্ধাত্রী
জগতজননী দেবী জগদ্ধাত্রী
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
জগদ্ধাত্রী হলেন দেবী দুর্গার আর এক রূপ। উপনিষদে এঁর নাম উমা হৈমবতী। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও এঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়। দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। জগদ্ধাত্রী মহাশক্তির প্রতীক, তিনি সর্বস্থানে বিচরিত।
ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী। সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী ও পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য।ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ। ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ ও পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা। সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত – যিনি নিত্যা, শাশ্বতী ও অপরিবর্তনীয়া। দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি।
শাস্ত্রমতে, জগতের যিনি পালনকারিণী ও শান্তি বিধায়িনী সেই জগদ্ধাত্রী রূপের সাধনা করলে মানুষ অদম্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। এই কারণে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে অবশ্যই জগদ্ধাত্রী দেবীর আরাধনা একান্ত ভাবে কাম্য। জানা যায় দেবী নাকি এই দিনেই মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং স্বয়ং দেবী পরে জয়রামবাটীর সারদা মায়ের গর্ভধারিণী শ্যামাসুন্দরী দেবীকে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে জানিয়েও দিয়েছিলেন। এই কারণে বঙ্গে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রসারের জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
জগদ্ধাত্রী দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দন্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। জগদ্ধাত্রী কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের প্রাণাত্মিকা। কিন্তু এই জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কি তা নিয়ে রয়েছে বহু মতান্তর।
তবে একটি কাহিনীও শোনা যায়। এক সময় বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। কথিত আছে যে কোন কারণে এই নবাব কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। মহারাজ ছিলেন খুবই দেবী ভক্ত এবং নিজ বাড়িতে স্বয়ং দুর্গাপুজো করতেন। কিন্তু সে বছর কারাগারে থাকার ফলে তা সম্ভব হয়নি। আবার যেদিন ছাড়া পেলেন সেদিন ছিল বিজয় দশমী। ঢাকের বাদ্যি বাজছে, সেটা শুনে মহারাজের মনে খুব দুঃখ হল। দেবী দুর্গার অন্তঃকরণেও ভক্তের বেদনা আঘাত করল। ফলে মায়ের পূজা করতে না পেরে বিধ্বস্ত দুঃখিত কৃষ্ণচন্দ্রকে দেবী সেই রাতেই স্বপ্নে দেখা দিলেন কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে আমার জগদ্ধাত্রী পূজা করো, তাহলে দুর্গাপুজোর মনোবাসনা পূর্ণ হবে। দেবীর স্বপ্নে বিশ্বাস করে ভক্তি ভরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা পূজা করেন। তাঁর দেখাদেখি চন্দননগরের ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরীও মহাধুমধাম সহযোগে সেখানে জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করে দেন। বর্তমানে কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরে দেবীর মহা আড়ম্বরে পূজার প্রচলন রয়েছে।
জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র। দুটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে। কেউ কেউ সপ্তমী থেকে নবমী অবধি দুর্গাপূজার ধাঁচে জগদ্ধাত্রী পূজা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নবমীর দিনই তিন বার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করেন। এই পূজার অনেক প্রথাই দুর্গাপূজার অনুরূপ।
জগদ্ধাত্রী পূজা খুবই প্রাচীন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই পূজার প্রচলন আছে। তবে সেই পূজা হয় দেবী সিংহবাহিনী নামে। মনেপ্রাণে এই দেবীর পূজা করলে মানুষের জীবন সার্থক হয়। দুর্গা দেবীর অপর নাম হল জগদ্ধাত্রী। তিনি শিবগৃহিণী। এই বিশ্বের রক্ষণ, পালন পোষিণী। অথচ নিত্যস্বরূপিণী, চিরন্তনী। তাঁর এই শাশ্বত অনবদ্য রূপের ধ্যান করলেও মানুষ আত্মজ্ঞান লাভের ধন্য হয়।
জগৎ ধারিণী মা মহামায়া জগদ্ধাত্রী, দূর আকাশে সূর্য যেমন পৃথিবীকে ধরে রয়েছে ঠিক তেমনি মা দুর্গা জগতকে ধারণ করে রয়েছেন। তাই দুর্গার আর এক অন্য রূপের নাম জগদ্ধাত্রী।
লেখক:সাংবাদিক