বুধবার ● ১৬ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » ঐতিহ্য হারাচ্ছে পাইকগাছার বাজারখোলা
ঐতিহ্য হারাচ্ছে পাইকগাছার বাজারখোলা
প্রকাশ ঘোষ বিধান, পাইকগাছাঃ ঐতিহ্য হারাচ্ছে পাইকগাছার বাজারখোলা। প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় স্মৃতি চিহ্ন মুছে যাচ্ছে। ভুলতে বসেছে ইতিহাস। কালের স্বাক্ষী হয়ে সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ২শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আম গাছ ও ভাংগা দোল মন্দির। কালের স্বাক্ষী বাজার খোলার ঐতিহ্যবাহী আম গাছটি নিয়ে নানা কৈতুহল রয়েছে। এ গাছটিকে ঘিরে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, মন্দির, পুকুরসহ উন্মুক্ত পরিবেশ। এই স্থানটি আবার বাজারখোলা নামে পরিচিত। জমিদার ভোলানাথ ঘোষোর কাছারি বাড়ি ছিলো এখানে। জমিদারির খাজনা আদায় করা হতো কাছারিতে বসে। খাজনা আদায় শেষে এখানে গান যাত্রা হতো। কলকাতা থেকে যাত্রাদল আনা হতো। দোল মন্দির, দূর্গা মন্দির, গাছতলা মন্দির ও বারের পুকুর মিলে নাম হয় বাজার খোলা। এটি এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী স্থান।
পাইকগাছার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত বাজারখোলা ও ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শুরুতে এখানে টোলে পড়ানো হতো। টোল বসতো মন্দিরের ঘরে। পন্ডিত শীকান্ত ভট্রাচার্য এ এলাকায় পূজা করতেন এবং টোলে ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। এরপর ১৯২৩ সালে সুখদা সুন্দরী এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা কালিন প্রধান শিক্ষক ছিলেন নুরুজ্জামান। কাছারির একতলা বিল্ডিং ও ভাঙ্গা মন্দিরে ক্লাস হতো। বিল্ডিংটি খুব পুরাতন ও ঝুঁকি বাড়ায় পরবর্তীতে পিছনে মাটির দেওয়াল আর বাঁশ চটা, গোলপাতা ও নাড়া দিয়ে ছাউনি তৈরি করা হয় স্কুল। জানা গেছে, বিদ্যালয়টি ১৯৮৫ সালে এমপিও ভুক্ত হয়। এর আগে বৈদ্যনাথ ঘোষ স্কুলের নামে জমি দান করেন। ভোলানাথ ঘোষের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় কন্যার পুত্র বৈদ্যনাথ ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা প্রাপ্ত হন। সে সূত্রে বৈদ্যনাথ ঘোষ দাদু ও দিদার নামে ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জমি দান করেন। বৈদ্যনাথ ঘোষ দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসাবে সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদ্যালয় চত্তরের প্রায় ২শত বছরের গাছটি কালের স্বাক্ষী হিসাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে। প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস শেষে মুক্ত বাতাসে গাছের তলায় বসে গল্প করে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ডালগুলিতে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা দোল খায়। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। গাছ তলায় জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা আম পড়লে তা কুড়াতে হুড়োহুড়ি লাগে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। এ গাছটির তলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩শ বাইসাইকেল তার ছায়ার তলায় রাখে।
কালের স্বাক্ষী ২শত বছরের আমগাছের সাথে জড়িয়ে থাকা ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী বিদ্যালয়ের বয়স ৯৯ বছর। সরকার একের পর এক পরিবর্তন হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। গড়ে উঠেছে নতুন ২টি ভবন। এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮শ ছাত্র-ছাত্রী, যা উপজেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বর্তমানে সভাপতি বলেন, আমরা বিদ্যালয় আধুনিক করার জন্য পরিশ্রম করছি। শিক্ষকদের গুনগত মান উন্নয়নে ডিজিটাল হাজিরা স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি শ্রেণীতে ২টি করে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষক সরদার বদিউজ্জামান বলেন, অফিস কক্ষে বসে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মনিটরিং করে থাকি। গাছটির সাথে কালের স্বাক্ষী হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেদ মন্দির। জমিদার আমলে নির্মিত এ মন্দির প্রতিষ্ঠানটি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এখনও উপাসনা করেন। এখানে প্রতি বছর চৈত্রের মাসের শেষ তারিখে চড়ক পূজা, মেলা, ১লা বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
স্কুলের উন্নয়নের ছোয়া লাগলেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দিন দিন দেখাশুনার অভাবে নষ্ঠ হওয়ার পথে। ১৯৮৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে দোল মন্দিরটি ভেঙ্গে যায়। মেইন সড়ক থেকে মন্দির ও পুকুরে প্রবেশ করতে পৃথক সড়কপথ যার দুই পাশে প্রাচীর ও রাস্তার ধারে গুম্বজ তৈরী ছিল। পুকুরের তিন পাশে পাঁকা ঘাট ছিল। স্থানীয় পুরাইকাটী গ্রামের সুনিল সেন (৭৭) এ বিষয়ে বলেন, আমি এ স্কুলে পড়েছি। চাটাই বিছিয়ে তালের পাতায় দোয়াত ও কুঞ্চির কলম দিয়ে লিখতাম। বারের পুকুরের বড় বড় দুটি গজাল মাছ ভেসে রেড়াতে দেখতাম। জমিদার ভোলানাথ এলাকাবাসীর পানিয় জলের বারের পুকুরসহ ৭টি পুকুর খনন করেন। আম গাছটি পিছনে রয়েছে বারের পুকুর। ৮০ উর্দ্ধ ঈশা বিশ্বাস জানান, তৎকালীন সময়ে পানীয় জলের অভাবের কারণে জমিদার ভোলানাথ ঘোষ এ পুকুরটি খনন করেন। পুকুরটিতে অলৌকিক কিছু দেখা যেত বলে নাম রাখা হয়েছিল বারের পুকুর। রাস্তার পূর্ব পাশে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী লেখার মাঠ। সবমিলিয়ে গাছটির সাথে মিলে-মিশে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, মন্দির। এতিহ্যবাহী বাজার খোলা ঘিরে রয়েছে ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পুকুর ও ঐহিত্যবাহী খেলার মাঠ। এ বাজার খোলার মনোমুগ্ধকর উন্মুক্ত পরিবেশ সবাইকে আকৃষ্ট করে। বিলিন প্রায় প্রতিষ্ঠান গুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে ঐহিত্যবাহী বাজার খোলার স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে এলাকাবাসী দাবী করেন।