বৃহস্পতিবার ● ৩০ জুন ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা
বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফলে যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার গুরুত্ব। ক্রীড়াঙ্গনের তাজা খবর গুলো ক্রীড়া সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল বা টিভির পর্দায় দেখতে ও জানতে পারি আমরা। যাদের মাধ্যমে খেলাধুলার সব খবর পেয়ে যাচ্ছি সে সব সাংবাদিকদের বলা হয় ‘ক্রীড়াঙ্গনের চোখ’। ক্রীড়া সম্পর্কিত বিষয়গুলির উপর প্রতিবেদন তৈরি করা সাংবাদিকদের বলা হয় ক্রীড়া সাংবাদিক।
১৯২৪ সালের ২ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (এআইপিএস) এর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবসের। বিশ্বের ক্রিড়া সাংবাদিকদের এক কাতারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে ২ জুলাই এআইপিএসের জন্মদিনকে স্মরণ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব ক্রিড়া সাংবাদিক দিবস। মূলত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা দিবসকে মাথায় রেখেই ১৯৯৫ সাল থেকে ২ জুলাই তারিখটিকে বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের সকল ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকরা নিজেদের জন্য আলাদা একটি দিন পায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ প্রায় ১৬৭টি দেশ এই ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে।
ক্রীড়া সাংবাদিকতার ভূমিকা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস পালন করা হয়। ক্রীড়া সাংবাদিক এবং লেখকরা হলেন ক্রীড়াঙ্গনের চোখ, মানুষের শব্দ এবং কণ্ঠস্বর। খেলাধুলা এখন তো আলাদা একটি জগৎ। আর এই বর্ণময় জগতের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। ক্রীড়া সাংবাদিকতা আর ক্রীড়াঙ্গন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এআইপিএস এর কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৯৯৫ সাল থেকেই সমিতি প্রতিবছর নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালন করে বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। প্রতি বছরই সন্মাননা জানানো হয় দেশের বরেণ্য ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকদের। এর ফলে অনেকটা আড়ালে চলে যাওয়া অগ্রজদের আজকের প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটে।
আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ভূমিকা এবং গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাড়ছে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সামাজিক ও বৈষয়িক মর্যাদা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ক্রীড়াঙ্গনের ক্ষেত্র অনেকটা সীমিত থাকায় ক্রীড়া সাংবাদিকতার পরিধিও সীমিত ছিল। তবে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কিছু সাফল্যে এ অঞ্চলের মানুষ ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে আলাদা করে ভাবনা খুজে যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৫৮ সালে ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল জয়।
তখনকার প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকের পাতায় কিছুটা হলেও খেলার খবর প্রকাশ পেত। খেলাধুলার সংবাদের জন্য আলাদা কোন ডেস্ক কিংবা রিপোর্টার ছিল না। অন্য খবরের পাশাপশি আগ্রহীদের দিয়েই এ সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা হত। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালে গঠিত হয় ‘পূর্ব পকিস্তান ক্রীড়ালেখক সমিতি’। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি’। বাংলাদেশে এআইপিএসের একমাত্র স্বীকৃত সংস্থা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি’। নতুন দেশে অন্যসব কিছুর মতো ক্রমেই বিকশিত হয় সংবাদ মাধ্যম ও ক্রীড়াঙ্গন। তবে নব্বইয়ের দশকে পাশাপাশি মিডিয়া এবং খেলাধুলা দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক বিপ্লব ঘটে। এখন বেশিরভাগ দৈনিক পত্রিকায় খেলাধুলার সংবাদের জন্য পূর্ণপৃষ্ঠা বরাদ্ধ থাকে। কোথাও কোথাও একাধিক পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকে। টিভি চ্যানেলগুলোর কল্যাণে ক্রীড়া সাংবাদিকতা পেয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি শুধু দেশে না দেশের বাইরেও তার দৃষ্টি রেখেছে ।
১৮০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুরু হয়। গোড়ার দিকে বিক্ষিপ্তভাবে ঘোড়দৌড় এবং বক্সিং খেলার সংবাদ প্রচার হতো। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে বক্সিং লড়াই সামাজিকভাবে অভিজাতদের কাছ থেকে প্রচুর আগ্রহ অর্জন করেছিল, যার কারণে ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুরুতেই ভালো সাফল্য পায় এবং খবরের কাগজের সংস্থাগুলির সাথে সংবাদ ব্যবসায়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে রূপান্তরিত হয়। ১৮২০ এবং ৩০ এর দশকে, সংবাদপত্রগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো সামাজিক অভিজাতরা, কারণ তখন সংবাদপত্র সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব ব্যয়বহুল ছিলো।
বিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যা মূলধারার ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে বর্ধনশীলতার দিকে পরিচালিত করে। প্রথমটি ছিল পেনি প্রেসের আবির্ভাব যা খবরের কাগজ উৎপাদন সস্তা এবং ট্যাবলয়েড শৈলী করার সুযোগ দেয়। সংবাদপত্রগুলি এইসময় শুধু প্রচারের উপর নির্ভর না করে তাদের উৎপাদন ব্যয়ের অর্থ যোগানের জন্য বিজ্ঞাপন ব্যবহার শুরু করে। এই দুটি কারণে সামাজিক অভিজাত উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনসংখ্যাও সংবাদপত্রের লক্ষ্যে পরিণত হয়। নিউইয়র্ক হেরাল্ড হ’ল ধারাবাহিক ক্রীড়া সংবাদ প্রচারের প্রথম পত্রিকা। ১৮৮৩ সালে শুরু হওয়া নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড একটি পূর্ণ সময়ের ক্রীড়া বিভাগের প্রথম পত্রিকা। ১৮৮০-১৯২০ এর পরবর্তী সময়কালে প্রকাশনাগুলিতে ক্রীড়া কভারেজের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রযুক্তি যেমন রেডিও, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের মতো নতুন প্রযুক্তি চালু হওয়ার কারণে, খেলাধুলার কভারেজের কেন্দ্রবিন্দুটি খেলা থেকে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ এবং খেলোয়াড়দের পটভূমির অংশগুলিতে স্থানান্তরিত হয়। সাধারণ জনগণের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি ঘটায়। ফুটবল, বাস্কেটবল এবং হকির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় আগ্রহী পাঠকদের কাছে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এর ফলে ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড জার্নাল, যা পুরোপুরি খেলাধুলায় ফোকাস দেওয়ার প্রথম প্রকাশনা ছিল।
বিশ্বজুড়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। যার রেশ ধরেই ক্রীড়া সাংবাদিকদের গুরুত্ব বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে সামাজিক মর্যাদা। অসংখ্য তরুণের আগ্রহের তুঙ্গে এখন ক্রীড়া সাংবাদিকতা। তবে সেটিকে শুধু মাত্র পেশা হিসেবে নিলেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব না। দক্ষতা, সৃজনশীলতার নেশা থাকলে এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সব জায়গাতেই অবাধ বিচরণ রয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকদের। তবে ক্রিকেট এবং ফুটবলের বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। দেশের ক্রিকেট ও ফুটবলের গোঁড়াপত্তন থেকে উথান-পতনের বিভিন্ন সময় ক্রীড়া সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্রিকেট-ফুটবলের, বিভিন্ন সফলতার সামনের ও পেছনের গল্প লিপিবদ্ধ এবং কন্ঠসরের মাধ্যমে জানান দিয়েছেন, তেমনি নানা অব্যবস্থাপনা-অনিয়মের খবর সামনে এনেছেন। এমন কোন অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ পেলে আমাদের দেশে সাংবাদিকরা একটু বেশিই প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, যার ব্যতিক্রম নন ক্রীড়া সাংবাদিকরাও। তারাও হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে যাত্রা অব্যাহত রয়েছে, এর পেছনে ক্রীড়া সাংবাদিকদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রথম দিকে যে ক্রিকেটকে অনেকেই চিনতোই না, ক্রীড়া সাংবাদিকদের লেখনীতে সেই ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আজ যেটি বিজ্ঞাপনের রমরমা বাজার। এই ক্রীড়া সাংবাদিকদের কারণে, দেশের ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। ক্রিকেটকে জানার-বোঝার সুযোগ হয়েছে দেশের অধিকাংশ মানুষের।
অতীত এবং বর্তমান সময়ে ক্রীড়া ক্ষেত্র মানেই সংবাদের যোগান। আর সেই যোগানের সম্মুখভাগেই অবস্থান ক্রীড়া সাংবাদিকদের। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ধরন পাল্টেছে। তাই আপন মহিমায় সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের যেভাবে উথান হয়েছে, এর পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকরা।
বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন একটা মানদন্ড তৈরি করে নিয়েছে। উপমহাদেশীয় পর্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ অন্যান্য স্পোর্টস রিপোর্টিংয়ে আমাদের সাংবাদিকরা যথেষ্ঠ সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভাল সুনাম আছে। তাদের মেধা, জানা-বোঝা ও লিখনীর প্রশংসা দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
লেখক:সাংবাদিক