বুধবার ● ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
প্রথম পাতা » উপকূল » উপকূলের নতুন বিপদ জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে
উপকূলের নতুন বিপদ জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে
জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে উপকূল। বছর বছর বাড়ছে পানি, প্লাবিত হচ্ছে আগের বছরের চেয়ে আরও বেশি এলাকা। বিশেষ করে ভরাকটালের পূর্ণিমায় এমনটি বেশি ঘটছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ উপকূলের নদনদী এখন আর অমাবস্যা-পূর্ণিমার উঁচু জোয়ারের পানি ধারণ করতে পারছে না। পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এতে পুকুর-ঘেরের মাছ ভেসে যাচ্ছে; ফসলহানি ও জমিতে লবণাক্ততা এবং বাড়িঘর ডুবে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। আগে যেসব এলাকা উঁচু ও সুরক্ষিত ছিল, সেসব এলাকাও এখন জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গত তিন দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি আর জোয়ারে পানিতে উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত ১৫ জেলার কয়েক লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জোয়ারের এই উচ্চতা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের কারণে হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলের নদনদীতে জোয়ারের এমন উচ্চতা দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিকে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অশনিসংকেত বলেও মনে করছেন তাঁরা।
নদনদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ারের এই প্রবণতার শুরু এক দশক আগে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে এটা শুরু। এরপর যত ঝড় আঘাত হেনেছে, সবক’টিতে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোতেও ৮ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতার জোয়ারের কবলে পড়ছে লোকালয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের মাটি, পানি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে।গত তিন দিন ধরে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা উঁচু জোয়ারে দিন ও রাতে দুই দফায় ভাসছে। এতে খাবার ও সুপেয় পানির সংকট যেমন প্রকট হচ্ছে, তেমনি উপকূলের কয়েক হাজার পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বিভিন্ন বাঁধ ও উঁচু স্থানে।
জোয়ারে চার দিন ধরে প্লাবিত হচ্ছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সমুদ্রে নিম্নচাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে উঁচু জোয়ারের পানিতে বন প্লাবিত হওয়ায় প্রাণীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বন বিভাগের এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা জানান, পুরো বন প্লাবিত হওয়ায় গহিনে খোঁজখবর নেওয়া যায় না। এ সময় কোনো প্রাণীর ক্ষতি হলেও সেই তথ্য সঠিকভাবে পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
বন্যপ্রাণীদের পানি থেকে রক্ষা করতে পরিকল্পনাতেই আটকে আছে কার্যক্রম। গত আগস্ট মাসের পূর্ণিমার সময়ও দু’বার করে প্লাবিত হয় সুন্দরবন।
বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৭০০ মৎস্য ঘের ও পুকুরের মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৩ হাজার পরিবার।
পায়রা নদীর প্রবল স্রোতে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বৃদ্ধি পেয়ে পানির তোড়ে উপজেলার দেউলি সুবিদখালী ইউনিয়নের মেহিন্দাবাদ পয়েন্টের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল মঙ্গলবার বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে (পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর) জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপরে।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার অন্তত ২৫ গ্রাম তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে অধিকাংশ আমনক্ষেত। ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে বাড়ির উঠান, ঘরের মেঝে ও রান্নার চুলা পানিতে ডুবে গেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে শতাধিক পরিবার।
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় অর্ধশতাধিক গ্রাম তলিয়ে গেছে। নিঝুমদ্বীপে ৪০ হাজার মানুষের বাস। এখানে নেই কোনো বেড়িবাঁধ। জোয়ারের পানিতে এবার ডুবে গেছে ঘরবাড়ি।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রায় অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। পানিতে তলিয়ে রয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি। এ ছাড়া অসংখ্য পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেড়ে গেছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ১৪টি ইউনিয়নে মাষকলাই, সদ্য বোনা রোপা আমন ও সবজি ক্ষেত মিলে ৫৫ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
বৃষ্টির কারণে বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা তলিয়ে গেছে। বগুড়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশেকুর রহমান জানান, গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৬ ঘণ্টায় জেলায় ১০৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রের্কড করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত এই মৌসুমে সর্বোচ্চ।
সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের বেশ কয়েকটি নদনদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই ফুট বেড়েছে। উপকূলীয় এলাকার জরাজীর্ণ ৩৫টি পয়েন্টে প্রায় ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এদিকে আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুরে খোলপেটুয়া নদীর ১০ হাত বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০০ বিঘা মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়। পরে তা স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে সংস্কার করা হয়েছে। খুলনার পাইকগাছা ও কয়রার বেড়ীবাধ ভেঙ্গে বিস্তৃন এলাকা প্লাবিত হযেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বগুড়ায় ১৪২ মিলিমিটার। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকায় সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম জানান, সুস্পষ্ট লঘুচাপটি স্থলভাগের ওপর দিয়ে পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জোয়ার পরিমাপক শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে বরিশাল অঞ্চলের প্রধান নদনদী বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৪৫ মিটার, ২০০৫ সালে ৩ দশমিক ৫১ মিটার, ২০০৬ সালে ২ দশমিক ৯৬ মিটার, ২০০৭ সালে সিডরে জোয়ারের এই উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২২ মিটার আর ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় জলোচ্ছ্বাসে হয় ৩ দশমিক ৬৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মের ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে জোয়ারের তীব্রতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার। ওই বছরের ১৫ জুলাই পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৬২ মিটার। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার সময় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ১০ মিটার থেকে ৪ মিটারের মধ্যে। ২০২০ সালে আম্পানে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার থেকে ৪ মিটারের ওপরে। ২০২১ সালে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ১ থেকে ৪ দশমিক ৩ মিটারের ওপরে। গত দু’দিন ধরে ৩ দশমিক ১৮ মিটার উচ্চতারও বেশি জোয়ারের পানিতে ভাসছে উপকূল। এসব নদীর জোয়ারের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৮৫ মিটার।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ মিলিমিটার করে উচ্চতা বাড়ছে বঙ্গোপসাগরের। ৩০ বছরে পানির উচ্চতা বেড়েছে ৬ ফুটেরও বেশি। পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে জোয়ারের বিস্তার বেড়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলছেন, আগস্টে বেশি বিক্ষিপ্ত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ঘূর্ণিঝড় না হলেও জোয়ারে পানির উচ্চতা বেড়েছে ১ থেকে দেড় মিটার।
গত সোমবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : এনহেন্সিং কোস্টাল রিজিলিয়ান্স ইন চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এই ঝুঁঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ চলতি শতাব্দীতে দ্বিগুণ হতে পারে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূলীয় এলাকার জনসংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ১০ লাখে দাঁড়াবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলের ৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে।
পানি বিশেষজ্ঞ ও পাউবোর সাবেক আঞ্চলিক প্রধান প্রকৌশলী সাজেদুর রহমান সরদার বলেন, নদী ভরাট হওয়া, দখল, দূষণসহ নানা কারণে আমাদের নদীগুলোর ধারণক্ষমতা আরও কমবে। তাতে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা আরও বাড়বে। অনেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দ্রুত বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মৎস্যসম্পদ ও নৌপথবান্ধব নদীকেন্দ্রিক অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে হবে।