শনিবার ● ৮ অক্টোবর ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিশ্ব ডাক দিবস
বিশ্ব ডাক দিবস
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে শুরু হয় ডাক সেবার অভিযাত্রা। পৃথিবীর প্রাচীনতম এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় প্রাচীন মেসোপটমিয়া হয়ে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পথ হেটে অগ্নিশিখা সংকেত, কবুতর পাঠিয়ে কিংবা ঘোড়ার পিঠে রানারের ঝুলির যুগ থেকে স্যামুয়েল মোর্সের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-মেল, হোয়াটসঅ্যাপেই সব কথা বলা হয়ে যায়। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও ডাকব্যবস্থার অন্য এক গুরুত্ব থেকেই গিয়েছে। হাতে লেখা চিঠির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ডাকে হয়তো চিঠি পাঠানো হয় না, কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে গেলে নিরাপদ ভরসাযোগ্য ব্যবস্থা সেই ডাকই। শতাব্দীর প্রাচীন এই ডাকব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই পালিত হয় ‘বিশ্ব ডাক দিবস’। ডাক সেবা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রতি বছর ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসটি বিভিন্ন দেশে ডাক পরিষেবাকে সম্মান ও প্রচারের জন্য এবং ডাক পরিষেবা এবং পণ্যগুলির প্রচলন বা প্রচারের জন্য পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডাক অধিদপ্তর দিবসটি পালন করছে।
৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস। ১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যন্ডের বার্ণে ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণে গঠিত হয় ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ)। ইউপিইউ গঠন করার মহেন্দ্রক্ষণটি স্মরণীয় রাখতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সেল ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য আনন্দ মোহন নারুলা ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ‘ডাক ইউনিয়ন দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা প্রস্তাবাকারে পেশ করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত ১৯তম অধিবেশনে নাম পরিবর্তন করে ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ রাখা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর দিবসটি ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে দেশে প্রতিবছর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে।
১৮৪০ সালে প্রথম ডাকটিকিট ব্যবহার হয় ব্রিটেনে। এর একযুগ পরে ১৮৫২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ডাকটিকিটের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় নাগরিক বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার।
১৮৭৮ সালে বিশ্ব ডাক সংস্থা গঠনের পর যেকোনো রাষ্ট্র থেকে পাঠানো চিঠি অন্য রাষ্ট্র বিনা মাশুলে গ্রহণ করতে বধ্যপরিকর হয়। তবে এর আগে এই নিয়ম ছিলো ভিন্ন। তখন একটি চিঠি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানো হলে যতোগুলো দেশের ভেতর দিয়ে যেতে হতো, সেসব দেশের ডাকটিকিট খামে লাগাতে হতো। এতে যেমন খরচ অনেক বেড়ে যেতো, ঠিক তেমনই অনেক ঝামেলারও ছিল। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করে দেশগুলো। তবে কোনো কিছুই ঠিক হচ্ছিলো না। অবশেষে ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ডাক সংস্থার ১৬তম অধিবেশন। আর ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
একটা সময় ছিল, যখন চিঠি ছিল মানুষে মানুষে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। দুই যুগ আগেও সবাই চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকত প্রিয়জনের চিঠির আশায়। সেই দিন আর নেই। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে স্মার্টফোন আর হরেক রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে কাগজের চিঠি প্রায় হারিয়ে গেছে। ডাক বিভাগও নিরন্তর লড়াই করছে প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে অস্তিত্ব রক্ষার। ডাক বিভাগের সোনালী অতীত কিছুটা হারিয়ে গেলেও ডাক বিভাগের কাছে বিশ্ব ডাক দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। আর তাই এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ৮টি বিশেষ খাম ও ৮টি সিলমোহর, ১৪টি বিশেষ সীলমোহর, ১০টি স্মারক ডাকটিকিট, দুটি সুভেনির শিট ও চারটি উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করেছে। ১৯৭৪ সালের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক সংস্থার শতবার্ষিক উপলক্ষ্যে ২৫ পয়সা, ১ টাকা ২৫ পয়সা, ১ টাকা ৭৫ পয়সা ও ৫ টাকা মূল্যমানের চারটি স্মারক ডাকটিকিট ও ৮ টাকা ২৫ পয়সা মূল্যমানের একটি সুভেনির শিট প্রকাশ করে। এটি বাংলাদেশের প্রথম সুভেনির শিট।
বাংলাদেশের ডাকটিকিটের ইতিহাস। ১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, তখন মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রীয় কাজে চিঠিপত্র ব্যবহার করতো। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো পাকিস্তানের নামাঙ্কিত ডাকটিকিট। যুদ্ধকালীন সময়ে, মুজিবনগর সরকারের কাছে নতুন করে ডাকটিকিট ছাপানোর সময় ছিলো না। তাই ডাকটিকিটের উপর থেকে পাকিস্তানের নাম মুছে দিয়ে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ ছাপ দিয়ে কাজ চালানো হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ক’জন আন্তর্জাতিক বন্ধু বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জন স্টোনহাউজ একজন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ এমপি এবং ব্রিটেনের পোস্টমাস্টার জেনারেল। সেই সুবাদে তিনি জানতেন কীভাবে একটি দেশের নিজস্ব ডাকটিকিট ছাপানো এবং প্রচার করতে হয়। ১৯৭১ এর ২৯ এপ্রিল স্টোনহাউজ, ভারতের খ্যাতিমান ডিজাইনার বিমান মল্লিকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জানতে চান, তিনি বাংলাদেশের ডাকটিকিট ডিজাইন করার কাজটি নিতে চান কী না। বিমান মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। অনেক ব্যস্ততার পরও মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের জন্য আটটি ডাকটিকিট এবং একটি ফার্স্ট ডে কাভারের ডিজাইন করেন। যেহেতু ডিজাইনের জন্য কোনো দিক নির্দেশনা ছিলো না- কতো মূল্যমানের ডাকটিকিট হবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বিমান মল্লিককেই। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক পাউন্ড অর্থাৎ ২১ রুপি ৮০ পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ডাকটিকিটগুলোর দাম। ৮টির মূল্যমান তিনি নির্ধারণ করেন- ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ ও ১০ রুপি। সেই ডাকটিকিট গুলোতে বাংলাদেশের নাম লেখা হয়েছিল ‘বাংলা দেশ’ এবং মুদ্রা রুপি। ১০ পয়সার ডাকটিকিটে ছিল বাংলাদেশে মানচিত্র। বাংলাদেশের মানুষের ভূখন্ড, তার দেশের পরিচয় বিশ্বকে জানানো ছিল এই ডাকটিকিটের প্রধান লক্ষ্য। তাই ডাকটিকিটে তিনি খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরারর দিয়ে যাওয়া কর্কটক্রান্তি রেখার কথা উল্লেখ করেন। ২০ পয়সার ডাকটিকিট, যেখানে ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে ডিজাইন করা হয়েছিল। নিজে একজন শিক্ষক হওয়ার সুবাদে একটি শিক্ষায়তনে হামলাকে তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই তো সবুজ জমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখাটির উপর লাল রক্তের ছোপ দিয়েছেন। পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ম্যাসাকার অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ ডাকটিকিটটি তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল।
বিংশ শতাব্দীতে ইমেইল ও ইন্টারনেটের যুগে জনগণ দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য সেবা আশা করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ হয়তো কিছুটা পিছিয়ে। দিতে পারছে না আশানুরূপ সেবাও। অথচ কুরিয়ার সার্ভিসের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ডাক বিভাগ সেবা দিয়ে আসছে। দেশের ১০ হাজার ডাকঘরে প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ডাক সেবায় নিয়োজিত। দেশে ৮ হাজার ৫০০ ডাকঘরকে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় তৃণমূল জনগোষ্ঠী সরকারের ২০০ ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। হাজার বছরের বৈশ্বিক বিবর্তনের পথ বেঁয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি যুগে ডাক সেবা প্রবেশ করেছে। সংবাদ আদান-প্রদানে প্রাচীনতম এই মাধ্যমটি সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সগৌরবে আজও তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে চিঠির যুগ শেষ হয়ে গেলেও ডাক সেবার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি বরং উত্তরোত্তর এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে। বহুমাত্রিক ডিজিটাল সেবা প্রদানের বদৌলতে উদ্ভাবনের হাত ধরেই আগামীর ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের পৃথিবীতেও ডাক সেবার প্রয়োজনীয়তা অব্যাহত থাকবে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট