রবিবার ● ২৩ অক্টোবর ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ভ্রাতৃদ্বিতীয়া
ভ্রাতৃদ্বিতীয়া
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
ভাইফোঁটা হিন্দুদের একটি উৎসব। এই উৎসবকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান বলা হয়। ভাই বোনের সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম। ছোট বেলায় মারামারি করা, ঝগড়া করা, খুনসুটি সব কিছু স্মৃতির পাতায় চির স্বরণীয় হয়ে থাকে। বড় হওয়ার পরও ভাই বোনের সম্পর্ক কমতি থাকে না। ভাই-বোনের উৎসব, খুনসুটির উৎসব, আন্দের উৎসব ভাইফোঁটা শুধু বাঙালিদের নয়, সারা দেশের বহু রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালিত হয়।
কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে কালি পূজার দুই দিন পরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি হিন্দু পজ্ঞিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিনে উদযাপিত হয়। মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের দিন শেষ হয়। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব।
ভাইফোঁটা হল একটি ঘরোয়া উৎসব। এইদিন বোনেরা ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে একটি ছড়া বলে ও বোনেরা ভাইদের দীর্ঘজীবন কামনা করে। ভাইরা বোনেদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। শঙ্খ বা উলু বাজানো হয় এই সময়। বোনেদের পছন্দমতো উপহার দেয় ভাইরা। এই ভাই-বোনেদের পছন্দের সব সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয়। ভাই ও বোনেরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে উৎসবটি পালন করা হয়। এই উৎসবের আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী ধর্ম ও মৃত্যুর দেবতা যম তাঁর বোন যমুনা বা যমির ঘরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় তিথিতে শুভ ক্ষণে দাদার কপালে তিলক লাগিয়ে তাঁর আরতি করে ঘরে আমন্ত্রণ জানান যমুনা। যতœ করে তাঁকে খাওয়ান। বোনের রন্ধন কুশলতায় এবং আতিথেয়তায় অত্যন্ত খুশি হয়ে যম তাঁকে আশীর্বাদ করেন, এই শুভ দিনে যাঁরা বোনের হাত থেকে ফোঁটা নেবে তাঁরা নরক যাত্রা থেকে মুক্তি মুক্তি পাবেন।
ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে- ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা। যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর। আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর। ভাইফোঁটা নিয়ে মহাভারতে আরও একটি কাহিনি বর্ণিত আছে। নরকাসুর নামে এক দানবকে বধ করার পর দ্বারকায় ফেরেন কৃষ্ণ। দাদার আগমনে সুভদ্রা বিশেষ পূজা করেছিলেন। কৃষ্ণের কপালে পূজার তিলক লাগিয়ে তাঁকে বরণ করেন সুভদ্রা। সে দিনও ছিল কার্তিক মাসের দ্বিতীয় তিথি। সেই থেকে এই উৎসব সারা দেশে পালন করা শুরু হয়।
অনেক সময় এই ছড়াটি বিভিন্ন পরিবারের রীতিনীতিভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। অতঃপর, বোন তার ভাইএর মাথায় ধান এবং দুর্বা ঘাসের শীষ রাখে। এই সময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি করেন। এরপর বোন তার ভাইকে আশীর্বাদ করে থাকে (যদি বোন তার ভাইয়ের তুলনায় বড় হয় অন্যথায় বোন ভাইকে প্রণাম করে আর ভাই বোনকে আশীর্বাদ করে থাকে)। তারপর বোন মিষ্টি দিয়ে ভাইকে মিষ্টিমুখ করায় এবং উপহার দিয়ে থাকে। ভাইও তার সাধ্যমত বোনকে উপহার দিয়ে থাকে। এইদিন বোন বা দিদিরা তাদের দাদা বা ভাইদের কপালে কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে দই বা চন্দনের ফোঁটা দেয়। তারপর ছড়াটি তিনবার পড়ে তিনবার ফোঁটা দেয়। এরপর মাথায় ধান ও দুর্বা ঘাসের শীষ রেখে আশীর্বাদ প্রদান করা হয়। দিদি হলে ভাই প্রণাম করে, বোন হলে দাদাদের প্রণাম করার রীতি। ভাই বা দাদাকে মিষ্টি খাইয়ে উভয়ের মধ্যে উপহার-আদান-প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ভাইফোঁটা একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। পশ্চিম ভারতের ভাইবিজ একটি বর্ণময় অনুষ্ঠান। সেখানে এই উপলক্ষে পারিবারিক সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়। মহারাষ্ট্রে মেয়েদের ভাইবিজ পালন অবশ্যকর্তব্য। এমনকি, যেসব মেয়েদের ভাই নেই, তাদেরও চন্দ্র দেবতাকে ভাই মনে করে ভাইবিজ পালন করতে হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট