শুক্রবার ● ১১ নভেম্বর ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডায়াবেটিস রোগ সচেতনতা
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডায়াবেটিস রোগ সচেতনতা
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার আক্রান্ত হলে সারা জীবন এই রোগ পালতে হবে। একটি কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ ডায়াবেটিস। যা বাংলাতে বহুমুত্র রোগ নামে পরিচিত। ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনই সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই জানতে হবে, এই রোগ যাতে না হয় তার উপায়, কেউ আক্রান্ত হলে নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ না করলে কি জটিলতা হতে পারে। সারা বিশ্বে নীরব ঘাতক ব্যাধি ডায়াবেটিস দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে একটি ক্যাম্পেইন বা অভিযান, যা ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৪ নভেম্বর কানাডীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক গ্র্যাণ্ট বেনটিং জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।
মহাসর্বনাশের রোগটির নাম ডায়াবেটিস। নানা দেশে তার হরেক নাম- বহুমুত্র, মধুমেহ, ডায়াবেটিস, মেলিশাস, এ-োক্রাইন এবং মেটারলিক ডিসঅর্ডারস। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে মধুমেহ বা ডায়াবেটিস বলা হয়। এই রোগে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একে নিঃশদ্ধ ঘাতক বলা হয়। যার জেরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। পৃথিবীতে ২৫ কোটিও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে জীবন যাপন করছে। বৈশ্বিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর সপ্তম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রোগটি এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারের উদ্বেগের বিষয়। এই অসংক্রামক রোগে ২০৪০ সালে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। বিশ্বে এখন প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিস রোগী মারা যাচ্ছে। এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ। বছরে বাড়ছে আরো ১ লাখ রোগী। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনি কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিসের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শর্করাজাতীয় খাবার খেলে তখন তা ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত হয়। ইনসুলিন হচ্ছে একধরণের হরমোন। এর কাজ হলো এই গ্লুকোজকে মানুষের দেহের কোষগুলোই পৌছে দেওয়া। সেই গ্লুকোজ শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করে। ডায়াবেটিস হলে মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে গ্লুকোজ পৌছাতে পারে না। এতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘণ ঘণ প্রস্বাব হয়। যখন প্রস্রাব বেশি হয়, তখন ডায়াবেটিসে ভোগারোগী তৃষ্ণাত হয়ে পড়ে। ঘণ ঘণ প্র¯্রাব হওয়ায় রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্লুকোজ বের হয়ে যায়। এতে করে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারে না দেহের কোষগুলো। ফলে রোগী দুর্বলতা অনুভব করে। রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে তার রক্তনালী, ¯œায়ু, কিডনি, চোখ ও হৃদযন্ত্রের নানা সমস্যা সহ নানা ধরণের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
শরীর যখন ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণে ক্ষমতা হারায় বা হরমোন নিঃসরণ হলেও কাজ করে না এর যে কোন একটির ফলশ্রুতিতে ডায়াবেটিস রোগ দেখা যায়। সাধারণ জীবন যাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভাস, দুঃচিন্তা, কাইক শ্রম কমে যাওয়ায় ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সাধারণভাবে ডায়াবেটিসের উপসর্গ খুব ভালো বুঝা যায় না। তারপরও কিছু উপসর্গ যেমন, ঘন ঘন প্রসাব, অতিরিক্ত পানি পিপাসা, ক্ষুধা ও দুর্বলতা, মানসিক সহ্য ক্ষমতা কমে যাওয়া, ঘা সারতে দেরি ইত্যাদি। তাছাড়া সহজ কথায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চাইতে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের-টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু বয়সে দেখা দেয়। কোন বিশেষ কারণ ছাড়ায় টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। এর জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত আমরা ডায়াবেটিস বুঝি। যা সূচনা হয় ৪০ বছরের পর। যাদের পরিবারে এ রোগ রয়েছে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যে পরিবারের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ৩০ বছর বয়সের পর নিয়মিত রক্তে গ্লুাকোজের পরিমাণ পরীক্ষা ও কিছু ব্যায়াম করলে এ রোগকে দীর্ঘায়ু করা সম্ভব।
বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা এবং এ দেশের ডায়াবেটিস চিকিৎসার পথিকৃত প্রফেসর মোহাম্মদ ইব্রাহীম এর ৩টি বিখ্যাত উপদেশই ডায়াবেটিস চিকিৎসার মূল মন্ত্র। তাহলো ইংরেজিতে তিনটি ‘ডি’। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ঔষধ। সু-শৃঙ্খল জীবন যাপনই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি। শৃঙ্খলা মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে তা হবে সারা জীবনের রোগ। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই। ডায়াবেটিস রোগীর জীবনযাপন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সময় এবং পরিমিত খাদ্যাভাস গড়ে তোলা খুবই গরুত্বপূর্ণ। এ রোগে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা সম্পর্কে ভালো ধারণা এবং চিকিৎস্যকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসসা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রোগটি সম্পর্কে জানা। এজন্য স্বাস্থ্য সু-রক্ষায় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎস্যার ব্যাপারে সকলে সচেতন হওয়া খুব জরুরী।
লেখক ;সাংবাদিক ও কলামিস্ট