বুধবার ● ২২ মার্চ ২০২৩
প্রথম পাতা » বিবিধ » দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা
পরিতোষ কুমার বৈদ্য; শ্যামনগর প্রতিনিধি : বিশ্ব পানি দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের দাবী জানিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে খুলনার বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণী পেশার মানুষ। ২২ মার্চ সকাল ১১ টায় খুলনা পিকচার প্যালেস মোড়ে লিডার্স, ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ, খুলনা জেলা জলবায়ু অধিপরার্শ ফোরামের আয়োজনে মানববন্ধন ও সমাবেশে এই দাবী তুলে ধরা হয়। এই দাবীর সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন খুলনার পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ, হিউম্যানিটিওয়াচ, বেলা, ছায়াবৃক্ষ, গতি সহ অন্যান্য সংগঠন।
উক্ত মানববন্ধন ও সমাবেশ প্রথমে ধারনা পত্র পাঠ করেন মেীসুমী রায়, সিডিপির বিভাগীয় সমন্বয়কারী এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব এর সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সহ-সভাপতি ও বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রমান মুকুল, বক্তব্য রাখেন রাজনৈতিক সংগঠক মিজানুর রহমান বাবু, বাপার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী এ্যাড. বাবুল হাওলাদার, ফোরামের নির্বাহী সদস্য ও মাসাস এর নির্বাহী পরিচালক এ্যাড. শামীমা সুলতানা শিলু, পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ এর সদস্য এ্যাড. জাহাঙ্গীর হোসেন, ফোরামের সদস্য ও ছায়াবৃক্ষ এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আলম বাদশা, ফোরামের সদস্য ও হিউম্যানিটিওয়াচ এর সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সেলিম, লিডার্স এর এ্যাডভোকেসি অফিসার পরিতোষ কুমার বৈদ্য, সিডিপির এস এম এ রহীম, গতির সমন্বয়কারী রেজওয়ান আশরাফ প্রমূখ।
বক্তারা বলেন, ভৌগলিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশে সুপেয় পানির সংকট অত্যন্ত প্রকট। এই সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় এলাকায় সবচয়ে বেশী। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানি সংকটের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ১৯ টি জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের বসবাস। আধারযোগ্য পানি সংগ্রহ করতে পারে না এদের প্রায় ৩ কোটি মানুষ এবং দেড় কোটি মানুষ ভুগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি পানে বাধ্য হচ্ছেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মতে যেখানে পানযোগ্য প্রতি লিটার পানিতে লবণের সহনীয় পরিমান ০ থেকে ১ হাজার মিলিগ্রাম সেখানে বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিলিটার পানিতে রয়েছে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণের উপস্থিতি।
মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, নদীভাঙন জনিত বন্যা, চিংড়ি চাষ, ভুগর্ভস্থ পানির লবনাক্ততার কারনে গত কয়েক বছরে সুন্দরবন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে। সুন্দরবন উপকুলে ৭৩% পরিবার সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত বা খারাপ পানি খেতে বাধ্য হয়। জীবিকা দুর্বলতা সূচক এবং পানি স¤পদ সূচকে সবচেয়ে উপরে রয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা।
উপকূলীয় অঞ্চলে গত ৩৫ বছরে লবণাক্ততা পূর্বের তুলনায় ২৬% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যার পরিমান ২ পিপিটি থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ভূভাগের অনেক ভিতর পর্যন্ত লোনাপানি ঢুকে পড়েছে, ফলে লোকজনকে পানি ও খাবারের সাথে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে লবণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এছাড়া লবাণাক্ততা বৃদ্ধি এ অঞ্চলের মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও ফেলেছে। চিকিৎসাবিদদের মতে এ এলাকার বসবাসকারীদের উচ্চ রক্তচাপ রোগে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে লবণাক্ততায় আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের প্রি-একলেম্পশিয়া ও উচ্চরক্তচাপের হার ৬.৮%-৩৯.৫% বেড়েছে। লবণাক্ততার কারনে উপকুলের নারীদের জরায়ু সংক্রমন বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে নারীকেই। ফলে নষ্ট হচ্ছে নারীর শ্রমঘন্টা। শিশুদের অনিরাপদ অবস্থায় রেখে যেতে হচ্ছে ও নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। রোগব্যাধি বাড়ছে, সামগ্রিক জীবনের গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্তের মতে শুধু সুপেয় পানির অভাবে উপক‚লের মানুষ এলাকা ছাড়বে। ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ, কর্মসংস্থানের অভাব, সুপেয় পানির সংকট, কৃষিকাজ সংকুচিত হওয়া প্রভৃতির কারনে উপকুল থেকে অভিবাসন বেড়েছে। ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সারা দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% থাকলেও ঐ সময়ে উপকুলীয় এলাকায় পুরুষের সংখ্যা কমে গেছে। এছাড়াও ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে নারীর সংখ্যা বেড়েছে যা দেশের অন্যান্য এলাকার থেকে ভিন্ন।
সারাদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও উপকূলীয় অঞ্চল বরাবরই অবহেলিত। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেশের এই অংশে বসবাসরত মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি সহসাই পরিলক্ষিত হয়। শত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও কয়েকটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যেগুলোর বাস্তবায়ন গতি অতীব শ্লোথ।
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল সুরক্ষায় বক্তারা যে সকল দাবী তুলে ধরেন, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলাকে জলবায়ু ঝুঁকিপুর্ণ বা দুর্যোগ ঝুঁকিপুর্ণ এলাকা ঘোষণা করতে হবে, দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚লীয় অঞ্চলকে রক্ষার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে, জলবায়ু ঝুঁকি, দারিদ্র্য ও বিপদাপন্নতার মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার অধীন উপক‚ল সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির (বিশেষ করে নগদ ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি) আওতা ও পরিধি বাড়াতে হবে, উপক‚লীয় সকল মানুষের খাবার পানির টেকসই ও স্থায়ী সমাধান করতে হবে, গ্রহণকৃত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রæত করতে হবে, আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধনে উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে, ঝড়-ঝঞ্ঝা, নদীভাঙ্গন ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূল, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্যারাবন বা সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে ও উপকুলের রক্ষাকবচ সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।