শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন
২৮৪ বার পঠিত
বুধবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। লাগাম হিন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। লাগাম যেন পরানো যাচ্ছে না। শব্দ দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রয়ে নেই তেমন কোন উদ্যোগ। ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা শহরেও বিভিন্ন ভাবে শব্দ দূষনের মাত্র বাড়ছে। সাধারণত একজন সুস্থ্য মানুষের শব্দের সহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবল। এর অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। মানব স্বাস্থ্যের জন্য শব্দ দূষণ নিরব ঘাতক। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণে পরিবেশে ভারসাম্যে বিঘœ ঘটছে।

সারাদেশে শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করে চলেছে। রাজধানী ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহর এমনকি গ্রাম-গঞ্জে শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষনায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার ৪৫টি এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা এর তুলনায় অনেক বেশি। গবেষনায় উঠে এসেছে, ঢাকার রাস্তার বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্ট, শিল্প এলাকা, বানিজ্যিক, আবাসিক, মিশ্র ও নির্জন এলাকায় মাত্রা ছাড়িয়ে শব্দ দূষণ হচ্ছে। উদাহরণ স্বরুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশ্ববর্তী এলাকার জন্য সহনশীল মাত্রা ৫০ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হলেও সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা ৭০ ডেসিবল। শুধু এখানেই নয় ঢাকার সকল হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এলাকা ও স্কুল-কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় শব্দ দূষণের  মাত্রা ছাড়িয়েছে। অন্যান্য স্থানে এর চেয়ে বেশি শব্দ দূষণ রয়েছে। ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস যানবাহনের হর্ণের অতিরিক্ত শব্দ। এছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ণ অতিরিক্ত শব্দ ঘটাচ্ছে। শুধু যানবাহনের হর্ণ নয়, বিভিন্ন কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি, রাস্তার পাশে দোকান গুলোতে উচ্চস্বরে চালানো অডিও-ভিডিও, প্রচার মাইকিং, অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার সহ সব মিলিয়ে শব্দ দূষণ মাত্রা ছড়াচ্ছে। শব্দ দূষণের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করায় এর শিকার হচ্ছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্ধারা। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের সেবাদানে বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শব্দ দূষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য এক নিরব ঘাতকব্যধী। একই জায়গায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের ক্ষেত্রে মানব শরীরের জন্য শব্দের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। কার্যত শব্দ দূষণের মাত্রা এর তুলনায় অনেক বেশী। আরো জানান, নিয়মিত শব্দ দূষণের মধ্যে বসবাসের কারণে মানুষের শ্রবণ শক্তি ক্ষয় ও কাজের আগ্রহ করে যাওয়ার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতা বাড়ে। এতো ঢাকা শহরের সামান্য চিত্র। শব্দ দূষণের মাত্রা ছাড়াচ্ছে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরে। এমনকি গ্রামের হাট বাজারেও শব্দ দূষণের মাত্রা অতিক্রম করেছে। উপজেলা আঞ্চলিক সড়ক গুলোতে ইঞ্জিন চালিত ভ্যান ও ট্রলি বিকট শব্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস ইঞ্জিন ভ্যান। এ ছাড়া ইট ভাঙ্গা মেশিন, উচ্চ শব্দে প্রচার মাইকিং, বিভিন্ন অনুষ্টানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার, গাড়ীর হর্ণ, রাস্তার পাশ্বে উচ্চ স্বরে অডিও-ভিডিও বাজানো, নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নদীতে ট্রলারের ভট ভট আওয়াজ ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিত্যদিন শব্দ দূষণের মাত্রা ছড়াচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর প্রয়োগ সহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য মতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের শিকার। মানবদেহের ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। ৫০ ডেসিবলের চেয়ে উচ্চ শব্দ মানবদেহে উচ্চ রক্তচাপ, ৬৫ ডেসিবলের চেয়ে উচ্চ শব্দ হৃদরোগ সৃষ্টিকারী, ৯০ ডেসিবলের বেশি উচ্চ শব্দ স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং ১২০ ডেসিবলের চেয়ে উচ্চ শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে। এমনকি গর্ভবতী নারী শব্দদূষণের মধ্যে থাকলে বধির সন্তানের জন্ম হতে পারে। এছাড়া শব্দদূষণের কারণে মাথাধরা, আতঙ্ক-অবসাদগ্রস্ত হওয়া, অনিদ্রা ও শিশুদের মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী নীরব ঘোষিত এলাকায় সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল ও শিল্প এলাকায় সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবলের বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্টির সুযোগ নেই। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী নীরব ঘোষিত এলাকায় হর্ন বাজানো দন্ডনীয় অপরাধ। আবাসিক এলাকার পাঁচশত মিটারের মধ্যে শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘন্টা মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। অনুমতি ব্যতীত শব্দ সৃষ্টি করলে প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে একমাস কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড এবং পরবর্তীতে প্রতিবার অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড আরোপ করা যেতে পারে।

আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। যে কোন ধরণের শব্দের ক্ষেত্রে কান অত্যান্ত সংবেদনশীল। সাধারণত ৫০ ডেসিবল এর মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের মাথা ব্যাথা, ঘুমের ব্যাঘাত মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কাজে মনোসংযোগের ব্যাঘাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। যা মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারত্মক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া শব্দ দূষণের কারণে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা কমে যায়। হঠাৎ উচ্চ শব্দের কারণে হৃদরোগীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ এর যানবাহনের সাইলের পাইপ থেকে ৭.৫ মিটার দূরত্বে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ ডেসিবল। যানবাহনের চালকরা আইন ভেঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দদূষণ করছে। শব্দ দূষণ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও শব্দ দূষণ মাপার যন্ত্র ব্যবহার করা দরকার। এর পাশাপাশি শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৬০ ডেসিবলের শব্দ মানুষের সাময়িক বধিরতা তৈরী করতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আধাঘন্টা থাকতে পুরোপুরি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়। সেখানে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে শব্দের গড়মাত্রা ৬০-৮০ ডেসিবলের মতো। যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ণ থেকে সৃষ্টশব্দ ৯০-৯৫ ডেসিবেল হয়ে থাকে। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চালানো মাইক ও লাউড স্পিকার থেকে সৃষ্টশব্দ গড়ে ৯০-১০০ ডেসিবল হয়ে থাকে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর। হিসাব মতে, বাংলাদেশের বড় শহর গুলোতে শব্দের দূষণ মাত্রা ‘হু’ কর্তৃক স্বীকৃত সীসার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী। কর্মজীবি মানুষকে নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে ৮০ ডেসিবেল মাত্রার বেশী শব্দের মধ্যে কাজ করতে হলে স্থায়ী বধিরতার সম্ভাবনা তৈরী হয়। অথচ ইস্পাত শিল্প, জাহাজ শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিয়জিত লাখ লাখ শ্রমিক এ স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে কাজ করে চলেছে। সর্বোপরি শব্দ দূষণ বন্ধে শব্দ সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জন সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং শব্দ দূষণ বিধিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর জন্য অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে জনসাধারণকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)