শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ১৭ মে ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মৌমাছি বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মৌমাছি বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
৩৪১ বার পঠিত
বুধবার ● ১৭ মে ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

মৌমাছি বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

আমাদের পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, বাসযোগ্য করে তোলার জন্য মৌমাছি পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মৌমাছি, প্রজাপতির মতো পরাগ বহনকারী কীটপতঙ্গ রক্ষার গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা ও পরিবেশে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য পালিত হচ্ছে বিশ্ব মৌমাছি দিবস। ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, পরিবেশ ধ্বংসের কারণে আজ মৌমাছি এবং অন্যান্য পরাগায়নকারী যেমন প্রজাপতি, বাদুড় এবং হামিংবার্ড বিলুপ্তির পথে। এই সব পরাগ বহনকারী কীটপতঙ্গ খাদ্যশস্যসহ একাধিক উদ্ভিদের প্রজননে সহায়ক। বাস্তুতন্ত্রের সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণী হিসেবে মৌমাছি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দরকার। তাই পরিবেশে এই সব পরাগ বহনকারী কীটপতঙ্গের স্থায়িত বজায় রাখার জন্য পালিত হয় এই দিনটি।

অ্যান্টন জনসা হলেন স্লোভেনীয় মৌমাছি পালক। অ্যান্টন জনসা আধুনিক মৌমাছি পালনের জনকও বলা হয়। ২০ মে হল অ্যান্টন জনসার জন্মদিন। ২০১৬ সালে স্লোভেনিয়া সরকার ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসাবে উদযাপনের ধারণাটি প্রস্তাব করেছিল এবং এটি ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলি দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল। জাতিসংঘ এর সিদ্ধান্তে প্রতি বছর ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস পালিত হচ্ছে।বিশ্ব মৌমাছি দিবসে, মানুষকে মৌমাছি পালন, উদ্যানপালন এবং কৃষি ফসলের ক্রস-পলিনেশনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়।

বিশ্বের বেশিরভাগ বন্য ফুলের গাছ প্রাণীর পরাগায়নের উপর আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। শুধু ফুলের গাছ নয়, খাদ্যশস্যের ৭৫ শতাংশেরও বেশি এবং বিশ্বব্যাপী কৃষি জমির ৩৫ শতাংশও পরাগায়নের ওপর নির্ভরশীল। পরাগায়নকারীরা শুধুমাত্র বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখে না বরং তারা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং অনেক উদ্ভিদের বেঁচে থাকা ও প্রজনন নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মৌমাছিরা বনের পুনর্জন্মকে সাপোর্ট করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে স্থায়িত্ব এবং অভিযোজন প্রচার করে।

সাতটি স্বীকৃত জৈবিক পরিবারে মৌমাছির ২০ হাজার টিরও বেশি প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। মৌমাছির কিছু প্রজাতি- যার মধ্যে ভ্রমর এবং অন্য প্রজাতির মৌমাছিরা সামাজিকভাবে উপনিবেশে বাস করে যেখানে বেশিরভাগ প্রজাতি একা থাকে।  অ্যান্টার্কটিকা ব্যতীত প্রতিটি মহাদেশে মৌমাছি পাওয়া যায়, পৃথিবীর যে যে স্থানে পোকামাকড়-পরাগায়িত ফুলের গাছ রয়েছে। মৌমাছি পরাগায়ন পরিবেশগত এবং বাণিজ্যিকভাবে উভয়ক্ষেত্রেই অত্যাবশ্যক এবং বন্য মৌমাছির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে, মধু মৌমাছির বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হাইভগুলির দ্বারা পরাগায়নের মান বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাচীনযুগে গ্রীস এবং মিশরের সময়কাল থেকে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মধ্যে মৌমাছি পালনের প্রচলন রয়েছে।

মধু, মোম ও ফুলের পরাগায়নের জন্য প্রসিদ্ধ পিঁপড়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গ বিশেষকে মৌমাছি বলা হয়। অ্যান্টার্কটিকা ব্যতীত পৃথিবীর সকল মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ-পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে সেখানেই মৌমাছি আছে। ফুলে ফুলে উড়ে মধু সংগ্রহের গুরুদায়িত্ব নিয়ে সব সময় ছুটে বেড়ায় মৌমাছি। কর্মব্যস্ততা, নিয়মানুবর্তিতা এবং পরিশ্রমের যথার্থ উদাহরণ ছোট্ট এই পতঙ্গ। কেবল তা-ই নয়, মৌচাক নির্মাণে মৌমাছির যে শৈল্পিক মনন, বিজ্ঞানমনস্কতা ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে পতঙ্গটিকে উঁচু স্তরের শিল্পী বললেও কম বলা হয়।

ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমের ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমু-ে পড়লে পরাগায়ণ ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ফল। এভাবে মৌমাছিরা পরাগায়ণের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে ফল ও ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।

প্রাণিজগতের অন্যতম পরিশ্রমী পতঙ্গ মৌমাছি। ক্ষুদ্র এই জীবের পরিশ্রমের পুরোটা ফল ভোগ করছি আমরা। এ দেশের আবহাওয়া প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষুদে আকৃতির এই মৌমাছি প্রজাতি গাছের কোটরে, দেয়ালের ফাঁটলে, বাক্স ইত্যাদি আবদ্ধ স্থানে বাসা তৈরি করে। এদের উৎপাদিত মধুর মান খুবই উৎকৃষ্ট।

প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে। আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্তঃ রানি মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি, ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি ও কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি। বিশ্বে প্রায় ২০হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত পাঁচ রকম মৌমাছির দেখা মেলে। সারা দেশে এদের দেখা মিললেও সুন্দরবনে মাত্র দুটি প্রজাতি এপিস ডরসেটা ও স্ট্রিং-লেস মৌমাছির দেখা পাওয়া যায়। মৌমাছিরা উপনিবেশে থাকে। একটি মৌচাক একটি মাত্র রাণী বা স্ত্রী মৌমাছি থাকে। রাণীকে কেন্দ্র করেই মৌচাক গড়ে ওঠে। প্রতিটি কলোনির রানী, কর্মী এবং ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি থাকে। কর্মীরা পরাগ এবং মধু সংগ্রহ করে এবং বাচ্চাদের যতœ নেয়।পরুষ মৌমাছি কোন কাজ করে না।পরুষ বা ড্রোন মৌমাছি কেবল রানী মৌমাছির সঙ্গে সঙ্গম করে। রানী মৌমাছি কেবল ডিম দেওয়ার কাজ করে। মৌমাছিরা গণতন্ত্র অনুসরণ করে। নতুন বাড়ি বাছাই করতে তাদের আলোচনা হয়।

মৌচাক হলো মৌমাছির আবাসস্থল। এটি তৈরি হয় মোম জাতীয় পদার্থ দিয়ে। মৌচাকে ক্ষদ্র ক্ষুদ্র ষড়ভূজ প্রকোষ্ঠ থাকে। মৌমাছি এসব প্রকোষ্ঠে মধু সঞ্চয় করে। এছাড়া ফাঁকা প্রকোষ্ঠে মৌমাছি ডিম পাড়ে, লার্ভা ও পিউপা সংরক্ষণ করে। মৌমাছি নিজেই দেহাভ্যন্তরে মোম তৈরি করে। এই মোম প্রকৃতপক্ষে ফ্যাটি এসিডের ইস্টার।

মধু হল এক প্রকারের মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করে। এবং মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন সুপেয় একটি ভেষজ তরল। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু স্বাদ, রং, হালকা সুগন্ধ এবং ঔষধিগুণাবলীর জন্য প্রসিদ্ধ। মধুর উপকারিতার কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। হরেক রোগের মহৌষধ মনে করা হয় মধুকে। মধু দৈহিক রোগের মহাঔষধ। পৃথিবীতে মধু একমাত্র খাদ্য যা কখনোই পচে না।

সাধারণভাবে বলা যায়, মধু হলো লাখ লাখ মৌমাছির অক্লান্ত শ্রম আর সেবাব্রতী জীবনের দান। মৌমাছিরা ফুলে ফুলে বিচরণ করে ফুলের রেণু ও মিষ্টি রস সংগ্রহ করে পাকস্থলীতে রাখে। তারপর সেখানে মৌমাছির মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত হয়ে রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়ায় মধু তৈরি হয়। এরপর মুখ হতে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে জমা করা হয়। আনুমানিক ১ কেজি মধু সংগ্রহের জন্য ১১০০ মৌমাছি প্রায় ৯০ হাজার মাইল পথ ঘুরতে হয়। যা কিনা চাদের কক্ষপথের প্রায় তিনগুণ। ফুলের হিসাব করলে দেখা যায় ১ কেজি মধু সংগ্রহের জন্য প্রায় ৪০ লক্ষ ফুলের পরাগরেণু স্পর্শ করতে হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে ভালো মৌসুমে প্রায় ৫৫ কেজি মধু জমা হয়। এসব তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি কর্মী মৌমাছি কি পরিমাণ পরিশ্রমী।

তবে উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে মৌমাছির সংখ্যা। মধু আহরন করার সময় মৌয়ালরা চাকে আগুন ও ধোয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে মধু আহরণ করেন। সোনাতন এই পদ্ধতীতে মধু আহরণ করায় প্রচুর মৌমাছি ও ডিম পুড়ে যায়। গত এক দশকে মোট মৌমাছির এক-তৃতীয়াংশ বিলুপ্ত হয়েছে। অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার, বন-জঙ্গল কেটে ফেলা, পরিবেশদূষণ প্রভৃতি কারণে এই উপকারী পতঙ্গ হ্রাস পাচ্ছে। যদি পৃথিবী থেকে মৌমাছি হারিয়ে যায়, তাহলে মানবসভ্যতা টিকবে থাকবে না। মৌমাছি ছাড়া খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না মানুষ। তাই এই দিনটির গুরুত্ব অনেক বেশি। মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য বাস্তুতন্ত্রে ছোট গুঞ্জনকারী প্রাণীরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)