শুক্রবার ● ১৬ জুন ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বনভোজন ; মন প্রফুল্ল করার অনুষঙ্গ
বনভোজন ; মন প্রফুল্ল করার অনুষঙ্গ
প্রকাশ ঘোষ বিধান
১৮ জুন আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবস। প্রতি বছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক পিকনিক ডে। পিকনিক শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘pique-nique’ থেকে। ফ্রান্সে শুরুতে কিছু ব্যক্তি বাসা থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে রাতে রেস্তোরাঁয় বসে খেতেন। সঙ্গে নিতেন ওয়াইন। সেই থেকেই পিকনিক শব্দটি মানুষের সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে।
অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আগ্রহী মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাইতো বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলছে বনভোজন আয়োজনের সংখ্যা। বিষয়টিকে আরো জনপ্রিয় করতে প্রতিবছরই ১৮ জুন পালিত হয় আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবস। মানুষের জীবনে বনভোজন-এর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন অনেকটা বয়ে চলে নদীর মতো। নদীতে যেমন জোয়ার আছে, ভাটা আছে এবং বর্ষায় প্লাবণে দুকূল ছাপিয়ে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া আছে। জীবনেও তেমনই সুখ, দুঃখ, হাসি এবং কান্না ইত্যাদি এসব লেগেই আছে।তাই এদের নিয়েই চলতে হয়। আর এসবের জন্যই পরিবারের সকলকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে বনভোজন করতে খোজা হয় মনোরম পরিবেশ। বনভোজন মানেই মানুষের মিলন, একে অন্যের সাথে আলাপ, পরিচয়, আনন্দ ও হইহুল্লোর মধ্যে সময় কাটানো। মনটাই যেন ভালো করে দেয় প্রাকৃতিক পরিবেশে।
পিকনিক ইংরেজি শব্দে। এর মূল অর্থ হলো আপন আপন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে পার্টিতে একত্রে ভোজন করা। তবে বাঙালি এখনও পিকনিক করে এবং মুখে বলে বনভোজন। বনভোজন শব্দটা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। তাঁর চিঠিপত্রে আগে পিকনিক শব্দটা দেখতে পাওয়া যেত। ১৯১১ সালে প্রকাশিত নাটক, অচলায়তন-এ হঠাৎ এল নতুন শব্দ বনভোজন। বঙ্গীয় শব্দকোষ–এ শব্দটির অর্থ পাওয়া গেল বনে রন্ধনপূর্বক ভোজন। পরে প্রকাশিত অন্যান্য অভিধানে বিস্তৃত অর্থ দেওয়া হলো—সংঘবদ্ধভাবে বনে বা রম্যস্থানে গিয়ে রন্ধন ও প্রীতিভোজন।
পিকনিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আপনি যখন কোনো উপলক্ষ ছাড়া বাইরে খেতে যান, সেটাকেই মূলত পিকনিক বলা হয়। আর বাংলায় পিকনিকের অর্থ বনভোজন। বনভোজনের মূল উদ্দেশ্য, ভালো খাবার খাওয়া ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া। সেই সঙ্গে মনকে চাঙা করা। এই দিবসের উৎপত্তি সম্পর্কে খুব একটা সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। পিকনিক শুরুর ধারণাটা ছিল এমন, খাবারের আয়োজনে সবার অবদান থাকবে। কোনো পার্কে বা প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে আনন্দ–ফূর্তি করবেন এবং একসঙ্গে বসে খাবার খাবেন। মূলত দুপুর ও রাতের খাবারের সময়টা বনভোজনের জন্য বেছে নেওয়া হতো। এখনো রীতি প্রায় তেমনই রয়েছে।
বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বনভোজন হয়। শীতকালে এটা বেশি হয়ে থাকে। তবে দেশে বিশ্ব পিকনিক বা বনভোজন দিবস ঘটা করে উদ্যাপন করার নজির খুব একটা নেই। বাংলাদেশে বনভোজনের ধারণাটা একটু ভিন্ন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই আয়োজন দেখা যায় বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও বছর বছর আয়োজন করেন বনভোজনের। অনেকে আবার তা পারিবারিকভাবে আয়োজন করে থাকেন। বনভোজন সাধারণত পরিবারের সদস্যদের ঘিরে হয়ে থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে দুজন ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি বড় ধরনের মিলনস্থলে রূপান্তরিত হয়। বনভোজনে যাত্রাকালীন কিংবা ফিরে আসার সময় আনন্দ, হাসি-তামাশা ইত্যাদি বিষয়াবলি থাকে। নির্দিষ্ট স্থানে রান্না আয়োজনের মধ্যবর্তী সময়কালে অথবা ভোজন পরবর্তী সময়ে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের নির্মল আনন্দ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। অনেকে নৌভ্রমণের মাধ্যমে বনভোজনের আয়োজন করেন।
বিশ্বের অনেক দেশে পিকনিক নিয়ে রয়েছে উন্মাদনা। তবে ২০০৯ সালে পর্তুগালের একটি বনভোজন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বনভোজনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। রাজধানী লিসবনের একটি পার্কে রিয়েলাইজার ইমপ্যাক্ট মার্কেটিং ও মডেল নামের একটি প্রতিষ্ঠান বনভোজনটি আয়েোজন করে। ২২ হাজার ২৩২ জন ওই বনভোজনে অংশ নেন। বনভোজনটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও স্থান করে নিয়েছে। পর্তুগালের বিভিন্ন স্থান থেকে ৪০০টি বাসে করে ওই পার্কে আনা হয়েছিল তাঁদের।
আন্তর্জাতিক বনভোজন দিবসটি কবে থেকে শুরু হলো, কারা শুরু করল- সেটা জানা যায়নি। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ফরাসিরাই এর উদ্যোক্তা। তবে বলা হয়, এর শুরুটা হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের শেষের দিকের কোনো একটা সময়। অর্থাৎ, ১৭৯৯ সালের আশপাশে।
ফরাসি বিপ্লবের আগে বড় পার্কগুলোয় সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারত না। ফরাসি বিপ্লবের পর সাধারণ মানুষের জন্য প্রথমবারের মতো পার্কগুলো খুলে দেওয়া হয়। আর মানুষজন তখন পার্কে গিয়ে খানাপিনা করত, মজা করত। ‘পিকনিক’ শব্দের উৎপত্তিও কিন্তু ফরাসি ভাষা থেকে। কেউ কেউ মনে করেন পিকনিকের প্রচলনটি ভিক্টোরিয়ান যুগেরও হতে পারে। ভিক্টোরিয়ান যুগে পিকনিক খুব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল। তারা গৃহের বাইরে একসঙ্গে সময় কাটাত। ভালো খাওয়া-দাওয়া করত।
বনভোজনের সময় কিন্তু দুনিয়ার সব দেশে এক রকম নয়। শীতপ্রধান দেশে বনভোজন হয় গরমকালে। আর আমাদের দেশসহ নাতিশীতোষ্ণ দেশে শীতকালে। শীতপ্রধান দেশে জুন মাসটাই হচ্ছে বনভোজনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। শীতের সময় তো ওদের দেশের বনজঙ্গল সব বরফে ঢাকা থাকে। সে কারণে ওরা গ্রীষ্মেই বনভোজনে যায়। বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে। সে কারণে ১৮ জুন ওরা বনভোজন দিবস হিসেবে পালন করে। ওদের সব দিবসই যে আমাদেরও পালন করতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। সেখানে তাদের কাছে এটা মজার হলিডে। একই ধরনের ছুটি হিসেবে প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম সোমবার ‘অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরি’ পালিত হয়। এ অঞ্চলের পিকনিকের দিন সরকারি ছুটি হয়। আসলে বনভোজন মানে আনন্দ-উৎসব সহযোগে বনে কিংবা বাড়ির বাইরে ভোজন। সাধারণত মনোরম ও সুন্দরতম স্থানকেই বনভোজনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। পার্ক বা উদ্যান, হ্রদ কিংবা নদীর কিনারের মতো চিত্তাকর্ষক স্থানকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
বনভোজন এমন একটি আয়োজন, যেখানে মানুষ তার প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা অন্তত এক দিনের জন্য হলেও ভুলে থাকতে চায়। মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করে। নিজের পরিচিতজনদের সময় দেয়। কিছু কিছু বনভোজনে আবার অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গেও পরিচিত হয়। বনভোজন একত্রে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, হৈ হুল্লোড়ে মfতিয়ে তোলা। সে এক অনাস্বাদিত আনন্দের মুহূর্ত। পিকনিক মানেই এক অন্যরকম মজা। অন্যরকম আনন্দ উদযাপন। আনন্দঘন সময়ের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পিকনিক। তুমুল আনন্দ বিজড়িত অবিস্মরণীয় মুহূর্তের এক মিলনমেলা। এ পিকনিক কখনো বনভোজন, কখনো চড়ুইভাতি হিসেবেও এক আলাদা আবেদনে মনকে দেয় উড়িয়ে। মনকে প্রফুল্ল করে তোলার গভীর অনুষঙ্গ বনভোজন। এই অনুষঙ্গকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রেল ইঞ্জিনের মতো বুকের ভিতর হুইসেল বাজার মায়াবি পিকনিকের সেই ফেলে আসা দিনের কথা।বনভোজনের অফুরন্ত সুখানুভূতির নির্যাস সিঞ্চিত করে মানুষ প্রাণস্পন্দনকে জাগিয়ে রাখে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট