মঙ্গলবার ● ১০ মে ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন
মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা প্রয়োজন
প্রকাশ ঘোষ বিধান
অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। লাগাম হিন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। লাগাম যেন পরানো যাচ্ছে না। শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রয়ে নেই তেমন কোন উদ্যোগ। ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা শহরেও বিভিন্ন ভাবে শব্দ দূষনের মাত্র বাড়ছে। সাধারণত একজন সুস্থ্য মানুষের শব্দের সহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবল। এর অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। মানব স্বাস্থ্যের জন্য শব্দ দূষণ নিরব ঘাতক। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণে পরিবেশে ভারসাম্যে বিঘœ ঘটছে।
সারাদেশে শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করে চলেছে। সে রাজধানী ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহর এমনকি গ্রাম-গঞ্জে শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষনায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার ৪৫টি এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা এর তুলনায় অনেক বেশি। গবেষনায় উঠে এসেছে, ঢাকার রাস্তার বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্ট, শিল্প এলাকা, বানিজ্যিক, আবাসিক, মিশ্র ও নির্জন এলাকায় মাত্রা ছাড়িয়ে শব্দ দূষণ হচ্ছে। উদাহরণ স্বরুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশ্ববর্তী এলাকার জন্য সহনশীল মাত্রা ৫০ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হলেও সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা ৭০ ডেসিবল। শুধু এখানেই নয় ঢাকার সকল হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এলাকা ও স্কুল-কলেজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা ছাড়িয়েছে। অন্যান্য স্থানে এর চেয়ে বেশি শব্দ দূষণ রয়েছে। ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস যানবাহনের হর্ণের অতিরিক্ত শব্দ। এছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ণ অতিরিক্ত শব্দ ঘটাচ্ছে। শুধু যানবাহনের হর্ণ নয়, বিভিন্ন কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি, রাস্তার পাশে দোকান গুলোতে উচ্চস্বরে চালানো অডিও-ভিডিও, প্রচার মাইকিং, অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউডস্পিকার সহ সব মিলিয়ে শব্দদূষণ মাত্রা ছড়াচ্ছে। শব্দদূষণের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করায় এর শিকার হচ্ছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্ধারা। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের সেবা দানে বিঘœ ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শব্দদূষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য এক নিরব ঘাতকব্যধী। একই জায়গায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের ক্ষেত্রে মানব শরীরের জন্য শব্দের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। কার্যত শব্দদূষণের মাত্রা এর তুলনায় অনেক বেশী। আরো জানান, নিয়মিত শব্দদূষণের মধ্যে বসবাসের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি ক্ষয় ও কাজের আগ্রহ করে যাওয়ার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতা বাড়ে। এতো ঢাকা শহরের সামান্য চিত্র। শব্দ দূষণের মাত্রা ছাড়াচ্ছে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরে। এমনকি গ্রামের হাট বাজারেও শব্দ দূষণের মাত্রা অতিক্রম করেছে। উপজেলা আঞ্চলিক সড়ক গুলোতে ইঞ্জিন চালিত ভ্যান ও ট্রলি বিকট শব্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে শব্দ দূষণের প্রধান উৎস ইঞ্জিন ভ্যান। এ ছাড়া ইট ভাঙ্গা মেশিন, উচ্চ শব্দে প্রচার মাইকিং, বিভিন্ন অনুষ্টানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার, গাড়ীর হর্ণ, রাস্তার পাশ্বে উচ্চ স্বরে অডিও-ভিডিও বাজানো, নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নদীতে ট্রলারের ভট ভট আওয়াজ ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিত্যদিন শব্দ দূষণের মাত্রা ছড়াচ্ছে। এক প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বিধিমালা অনুযায়ী শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ এবং ট্রাফিক বিভাগকে। অথচ হাইড্রোলিক হর্ণ বন্ধে এখনো তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি সংস্থার তিনটি। তবে ৫ বছরে ঢাকা সহ বড় বড় শহরে সংস্থা তিনটি যৌথভাবে ৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় সহ শব্দ দূষণকারী হর্ণ খুলে নেয়া হয়েছে ৫শত গাড়ী থেকে। তবে তাতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর প্রয়োগ সহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ এর যানবাহনের সাইলের পাইপ থেকে ৭.৫ মিটার দূরত্বে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ ডেসিবল। যানবাহনের চালকরা আইন ভেঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দদূষণ করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মোবাইল কোর্র্ট আইন ২০০৯ এর আওতায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অন্তভূক্ত না থাকায় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে আইনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছেনা পরিবেশ অধিদপ্তর। বিষয়টি আইনের তালিকায় অন্তভূক্তির লক্ষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রালয় উদ্যোগ দিয়েছে। বিধিমালাটি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে সরকার। যার প্রধান উদ্দেশ্য হয় শব্দদূষণ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও শব্দদূষণ মাপার যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর জন্য অতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচার-প্রচারণা চারিয়ে জনসাধারণকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করা। এর পাশাপাশি শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। যে কোন ধরণের শব্দের ক্ষেত্রে কান অত্যান্ত সংবেদনশীল। সাধারণত ৫০ ডেসিবল এর মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের মাথা ব্যাথা, ঘুমের ব্যাঘাত মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কাজে মনোসংযোগের ব্যাঘাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। যা মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারত্মক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা কমে যায়। হঠাৎ উচ্চ শব্দের কারণে হৃদরোগীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৬০ ডেসিবলের শব্দ মানুষের সাময়িক বধিরতা তৈরী করতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আধাঘন্টা থাকতে পুরোপুরি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়। সেখানে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে শব্দের গড়মাত্রা ৬০-৮০ ডেসিবলের মতো। যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ণ থেকে সৃষ্টশব্দ ৯০-৯৫ ডেসিবেল হয়ে থাকে। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চালানো মাইক ও লাউড স্পিকার থেকে সৃষ্টশব্দ গড়ে ৯০-১০০ ডেসিবল হয়ে থাকে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর। হিসাব মতে, বাংলাদেশের বড় শহর গুলোতে শব্দের দূষণ মাত্রা ‘হু’ কর্তৃক স্বীকৃত সীসার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী। কর্মজীবি মানুষকে নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে ৮০ ডেসিবেল মাত্রার বেশী শব্দের মধ্যে কাজ করতে হলে স্থায়ী বধিরতার সম্ভনা তৈরী হয়। অথচ ইস্পাত শিল্প, জাহাজ শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিয়জিত লাখ লাখ শ্রমিক এ স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে কাজ করে চলেছে। সর্বোপরি শব্দ দূষণ বন্ধে শব্দ সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জন সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং শব্দ দূষণ বিধিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে।