বৃহস্পতিবার ● ২ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » সাহিত্য » মননশীল লেখক কাজী ইমদাদুল হক
মননশীল লেখক কাজী ইমদাদুল হক
বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কাজী ইমদাদুল হক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, কবি, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, শিশু সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে যেসকল বাঙ্গালী মুসলমান মননশীল গদ্য লেখক বিশিষ্টতা অর্জন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী ইমদাদুল হক। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর তৎকালীন মুসলমান সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাতিক্রমধর্মী প্রতিভার অধিকারী হয়ে সাহিত্য অঙ্গণে আবির্ভূত হন।
স্বল্প সংখ্যক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভে সক্ষম হন। তাঁর অন্য কিছু রচনা থাকলেও একটি মাত্র অসমাপ্ত উপন্যাস আব্দুল্লাহ রচনা করে তিনি যে কৃতিত্বের নির্দেশনা রেখে গেছেন, তাতেই তিনি বাংলা সাহিত্যে চির স্মরণীয়। আব্দুল্লাহ উপন্যাসে যে বিষয়বস্তু উপস্থাপনা করা হয়েছে তাতে বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বাঙালী মুসলমান সমাজে যে অবস্থা ছিল তার একটি নিখুঁত চিত্র বিধৃত হয়েছে।
বিশ শতকের সূচনালগ্নে যন্ত্রণাজর্জর এই যুগপ্রতিবেশে বাংলা সাহিত্যে মুক্তচিত্ত দ্রোহী এক আধুনিক শিল্পী রুপে আবির্ভূত হন কাজী ইমদাদুল হক। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, উদার মানবতাবাদী, মননশীল এবং যুক্তিবাদী শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ঔপন্যাসিক। কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথালালিত সামন্ত-মূল্যবোধে স্নিগ্ধ মুসলিম সমাজ-অঙ্গণে বাসন্তী হাওয়ার প্রত্যাশায় ইমদাদুল হক সাহিত্যক্ষেত্রে দ্রোহীসত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবু তিনি বিদ্রোহী নন, সমাজ ভাঙ্গার ডাক নেই তার কর্মে-বরং মুসলিম সমাজের বিবিধ খন্ডচিত্র আর গ্লানির অঙ্গন উপস্থাপন করেই তিনি তৃপ্ত থেকেছেন। মুসলমান সমাজের সয়িষ্ণু আর্দশ ও রীতিনীতির বিপরীতে স্বাধীনচেতা ও প্রগতিশীল মনের নব্যসমাজ প্রতিষ্ঠার বাসনাই তাঁর উপন্যাসে ঔপন্যাসিক প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। চুয়াল্লিশ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে ইমদাদুল হকের প্রধান কীর্তি আবদুল্লাহ্ (১৯৩৩) উপন্যাস। একটিমাত্র উপন্যাস লিখে ইমদাদুল হক বাংলা সাহিত্যে রেখে গেছেন তার স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর।
১৮৮২ সালে ৪ নভেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর গ্রামে কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ কাজী ইমদাদুল হক জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা কাজী আতাউল হক। কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। কাজী ইমদাদুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের স্কুলে ও পারিবারিক পরিবেশে। জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে ছিল তাঁর পিতার বন্ধুত্ব। প্রফুল্য চন্দ্র রায়ের উৎসাহ ও পরামর্শে কাজী ইমদাদুল হকের পিতা তাকে ১৮৯০ সালে খুলনা জেলা স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ১৮৯৬ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রার্স পাশ করেন। ১৮৯৮ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন তিনি পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে ডিগ্রী ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু পরীক্ষার আগে অসুস্থতার কারণে অনার্স পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন।
কাজী ইমদাদুল হকের কতিপয় পাঠ্য পুস্তক ও রচনাগুলি হল কবিতা আঁখিজল ১৯৯০, আব্দুল্লাহ ১৯৩৩, প্রবন্ধ-মোসলেম জগতের বিজ্ঞান চর্চা ১৯০৪, প্রবন্ধমালা প্রথম খ- ১৯১৮, প্রবন্ধমালা দ্বিতীয় খ- ১৯১৬ শিশু সাহিত্য নবী কাহিনী, কামারের কান্ড ১৯১৯, পাঠ্য পুস্তক ভূগোল শিক্ষা প্রনালী, প্রথম ও ২য় ভাগ ১৯১০, সরল সাহিত্য। তিনি শিক্ষক নামে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তিনি ছিলেন সুপরিচিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অন্যতম স্থপতি এবং সমিতির মুখপত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার পরিচালনা কমিটির সভাপতি।
কাজী ইমদাদুল হক ১৮৮২ সালে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী আতাউল হক আসামের জরিপ বিভাগে চাকরি করতে করতেন এবং পরবর্তীতে খুলনার ফৌজদারি আদালতের মোক্তার নিযুক্ত হন।
১৯০৪ সালে খুলনা শহরে মৌলভী আব্দুল মকসুদ সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা সামসন্নেসা খাতুনকে বিয়ে করেন। কাজী ইমদাদুল হকের চার পুত্র ও ২ কন্যা- কাজী আনারুল হক, কাজী সামছুল হক, কাজী আলাউল হক, কাজী নুরুল হক এবং কন্যা জেবুন্নেছা ও লতিফুন্নেছা।
১৯০০ সালে কাজী ইমদাদুল হক কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ সম্পন্ন করেন। ১৯০৩ সালে কাজী ইমদাদুল হক কলকাতা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এর দুই বছর পর ১৯০৬ সালে আসামের শিলং বিভাগে শিাবিভাগের উচ্চমান সহকারী হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৭ সালে তিনি ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক হন। ১৯১১ সালে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভূগোলের অধ্যাপক হন। এরপর ১৯১৪ সালে ঢাকা বিভাগে মুসলিম শিক্ষা সহকারী স্কুল পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৪ সালে তিনি বিটি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৭ সালে তাকে কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২১ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের সুপারিন্টেনডেন্ট হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
শিক্ষা বিভাগে বিভিন্ন কাজে অসামান্য দক্ষতা, গভীর দায়িত্ববোধ ও উদ্ভাবনী শক্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯১৯ সালে খান সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন ও ১৯২৬ সালে তাকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে।
কাজী ইমদাদুল হক কখনো সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। সারা বছর কোন না কোন অসুখ-বিসুখ লেগে থাকতো। ১৯২৬ সালে তিনি কিডনী রোগে আবারও আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় চিকিৎসায় কোন প্রতিকার না হলে হেকিমী চিকিৎসার জন্য দিল্লির উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন। কলকাতায় অবস্থান করাকালীন ১৯২৬ সালের ২০মার্চ ৪৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। বিংশ শতাব্দীর বরেণ্য সু- সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হককে গোবরা কবরস্থানে তার মাতার কবরের পাশে দাফন করা হয়।