সোমবার ● ৬ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » উপকূল » ১২ নভেম্বর উপকূল দিবস ঘোষিত হোক
১২ নভেম্বর উপকূল দিবস ঘোষিত হোক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ভয়াল ১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর কাছে এক ভয়াবহ কালরাত হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭০ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় আজও অনেকে শিউরে ওঠেন।
ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর) উপকূলে। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও পটুয়াখালী পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য লাশ। মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। তথ্যমতে, ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। এ ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। একে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। এছাড়া দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে তড়ান্বিত করেছে তৎকালীন পাকিস্তান সকরারের অবহেলায় লাখো মানুষের মৃত্যুর সেই ঘটনা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দুর্যোগের সতর্ক বার্তা দেয়নি। প্রাণহানির পর উদ্ধারকাজেও ছিল চরম অবহেলা। এই অবহেলার কারণে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত উপকূলীয় জেলাগুলোর ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ভোলায় অনেক এলাকা জনমানুষশুন্য হয়ে পড়ে। অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায় এই জেলায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দুইদিন পরই ভোলা পরিদর্শনে যান। অবহেলায় করুণ মৃত্যুর সেই ঘটনা ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুধ্যান এবং ২৫ মার্চের কালরাতের মতোই মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ত্বরান্বিত করেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব- এ তিনটি নির্দেশকের আওতাভুক্ত উপকূলীয় ১৯টি জেলা। এর মধ্যে ১৬ জেলা প্রত্যক্ষভাবে উপকূলবর্তী। এগুলো হল- পূর্ব উপকূলের ৬ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর; মধ্য উপকূলের ৭ জেলা ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের ৩ জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। বাকি ৩ জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ; এগুলো হচ্ছে- যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। এদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। এ দেশের উপকূলের জনগোষ্ঠী প্রতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট নানা রকম দুর্যোগ আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, চাষের জমির জলাবদ্ধতা। আর এসবের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষ।
জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল জিডিপিতে কম-বেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখছে। বিপুলসংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার। এসব উপকূলজুড়ে যেমন রয়েছে নানা সমস্যা; তেমনি রয়েছে অপার সম্ভাবনা।উপকূলের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি তুলে ধরতে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। তাই পরিবেশবাদী সংগঠণগুলো ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়।
উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। ১২ নভেম্বরের ঘটনা উপকূলবাসী আজও ভুলেনি। এটাই উপকূলবাসীর কাছে নিঃসন্দেহে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল পুরো উপকূল। এ পর্যন্ত ইউকিপিডিয়ার রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এটি ১৯৭০ সালের উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ষষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল।
দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, নিরাপদ খাদ্য প্রবাহ এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় উপকূলীয় এলাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সে অনুযায়ী উপকূলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায়ও নেই কার্যকর পদক্ষেপ। ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানীর ঘটনাটি জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) পৃথিবীর ইতিহাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের ৭০ এর ভয়াল ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। তাই এই দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড গঠন, উপকূলে ১০-১৫ ফুট উচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বেড়িবাঁধ ঢালে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলে যে ভয়াবহতা হয়েছে, তা এ প্রজন্মের মানুষ জানে না। এই দিনে উপকূল দিবস হিসেবে পালন করলে এ প্রজন্মের মানুষ মনে রাখবে। বাংলাদেশের স্বকীয় ও বিশ্বব্যাপী পালিত দিবসগুলোর অধিকাংশই প্রায় নিয়মিত পালিত হয় এবং হয়ে আসছে। তবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বহুল প্রচলিত কিছু কিছু দিবস নানা কারণে বাংলাদেশে পালিত হয় না। কিন্তু দেশে ২০১৭ সাল থেকে উপকূল দিবসের দাবি তুলছেন উপকূল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম, কোস্টাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক,বনবিবি, আলোকযাত্রা, নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ প্রায় ১০০টি সংগঠন উপকূল দিবস পালন করছে। উপকূলে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়,৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০১৫ সালের সিডর, সিডর-পরবর্তী আইলা, হারিকেন, নার্গিস, রোয়ানু, মোরাসহ বিভিন্ন দুর্যোগের আঘাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু ঘূর্ণিঝড় এলেই প্রচারমাধ্যমের ক্যামেরাটা উপকূলের দিকে ছুটে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে উপকূলে জীবনযাপন কতটা যে অস্বাভাবিক, তা গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে আসে না। এ জন্য বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের স্মরণ, দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষদের সচেতন, উপকূলের সমস্যা আর সম্ভাবনাকে প্রকাশের আলোয় আনার জন্য ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস পালন করা। দিবসটি যখন জাতীয় পালন হবে, তখন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপকূল ফোকাস হবে এবং উপকূল সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। আর দিবসটি শুধু, উপকূলে বসবাসরত ৫ কোটি মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে নয় দেশের উন্নয়নের স্বার্থে।ইতোমধ্যে উপকূল দিবস জন্য যে আন্দোলন হচ্ছে তা স্থানীয়,জাতীয় ও আস্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকার মানুষরা দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উপকূলীয় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষদের ভূমিকাও কম নয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদ উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষকে। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এনজিওসহ গণমাধ্যমেরও থাকবে বিশাল ভূমিকা। সবাই মিলে আমরা উপকূলের জন্য একটি দিবস চাই, যেটি হবে উপকূল দিবস।শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় এটি হোক বিশ্ব উপকূল দিবস। এটি এখন সময়ের দাবি, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পাঁচ দশকে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ১২ নভেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপকূল দিবস হিসেবে পালনের দাবি বাস্তবায়ন করবে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট