শনিবার ● ৪ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » পরিবেশ » জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত
জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত
প্রকাশ ঘোষ বিধান
আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭২ সালের জুন মাসে সুইডেনের স্টকহোমে জাতিসংঘের মানব পরিবেশের ওপর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ২৭ তম অধিবেশনের প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ সম্মেলনের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ দিবস উদযাপিত হচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভুমি বাংলাদেশ। সবুজ বন, নদী, নালা ও জলপ্রপাত এদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আরো মনোরম করেছে। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ন স্থানে রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা কারনে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি আক্রান্ত হয়েছে জনজীবনে নেমে এসেছে নানা বিপর্যয়। বিশ্বে মানুষের যত রকম ঝুকি রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা তার মধ্যে অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য মুলত কার্বন ডাই অক্সাইড কে দায়ী করা হয়। কিন্তু এর সাথে মিথেন, নাইট্রস অক্সাইড, ক্লোরফ্লরো ইত্যাদি গ্যাস বিশেষ ভুমিকা রাখে। গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতি, প্রযুক্তি ও শিল্প উন্নয়নে নির্মানকারী কারখানা, শিল্প কারখানা থেকে বায়ু মন্ডলে সি,এফ সি গ্যাস যুক্ত হচ্ছে। মানুষের অসচেতন কর্মকান্ডের ফলে বায়ু মন্ডলে এসব গ্যাস যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতায় ভুমিকা রাখছে। ১৯১৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানুষের কর্মকান্ডের ফলে গ্রীন হাউজে ৭০ ভাগ গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে। মুলত এ কারনে পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। যার পরিনতি হচ্ছে ভয়াবহ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ঝুকিপূর্ন দেশে পরিনত হয়েছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুর্নিঝড়, বন্যা, খরা, ভুমি কম্পন, জলোচ্ছাস, পাহাড় ধস, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া, অসময়ে অধিক বৃষ্টি ও অধিক খরা সহ বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারনে হিমালয়ের বরফ, উত্তর মেরু ও এ্যান্টাকটিকার বরফ গলতে শুরু করেছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। গত ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১৫ সেঃ মিঃ থেকে ২৫ সেঃ মিঃ। বছরে বৃদ্ধির হার ১.৫ সেঃ মিঃ থেকে ২.৫ সেঃ মিঃ। যা গত ৩০০ বছরের ১০ গুন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশংকা তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী শতকে সমুদ্রের উচ্চতা বছরে বৃদ্ধি পাবে ৩০ সেঃ মিঃ থেকে ৪০ সেঃ মিঃ। এর ফলে পৃথিবীর অনেক নিম্ন অঞ্চল তলিয়ে যাবে। সূত্র মতে বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর ৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যু বরণ করবে। পৃথিবীর ১০ভাগ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। বছরে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম পরিমান ক্ষতি হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বায়ূ মন্ডলের পুজ্ঞিভুত গ্রীন হাউস গ্যাস উৎসারণে বিশ্ব উষ্ণায়নে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে দক্ষিন পশ্চিম উপকুলীয় এলাকায় ক্রমাগত ঝুকি বাড়ছে। সাগরে প্রতিনিয়ত নিম্নচাপ, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, খরা, কৃষিকে বাধাগ্রস্থ করছে। পানি, প্রানী সম্পদ ও নগর উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন বড় চালেজ্ঞ হয়ে দাড়িয়েছে। জীব বৈচিত্র বিপন্ন হচ্ছে এবং ভুমি, বনাঞ্চল, শিল্পবাসস্থান পশু সমস্যা প্রকট হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মারাক্তক ঝুকিপুর্ণ। উপকুল বাসীকে প্রকৃতির ঢাল হিসাবে ঘুর্নিঝড় সিডর সহ বিভিন্ন দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে সুন্দরবন হয়েছে নিজে লন্ডভন্ড। বাংলাদেশে সংঘটিত বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৯ ও সম্প্রতি ২০১৬ সালে বন্যা ও ঝড়ে দেশের বহুলোকের মৃত্যু হয়েছে। সূত্র মতে, তাপ মাত্রা ০.৫ থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পায় তবে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন পানিতে তলিয়ে যাবে। প্রতি বছর সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা ৩ মিলি মিটার করে বাড়ছে। আইপিসিসির ৪র্থ সমীক্ষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে মে মাসে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গড় বৃষ্টিপাত ও মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ঘুর্নিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা আশাংকা করছে আগামী ৫০ বছরে বিশ্বরে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী থেকে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ ১ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে সুন্দরবন সহ উপকুলীয় এলাকা তলিয়ে যাবে। উপকুলীয় ১৩ জেলার ৬৩ উপজেলার ৫৬ লক্ষ ৩৭ হাজার ৮ শত ৭৬ একর জমি তলিয়ে যাবে। যা দেশের মোট জমির ১৫.৮ ভাগ। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে আংশিক তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তু হারা হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে আসবে বিপর্যয়। বিপন্ন হবে উপকুলীয় অঞ্চল।
মানব সভ্যতার উন্নয়ন কাযক্রমে মানুষের অসচেতন কর্মকান্ডে আমাদের কৃষি, বনজ, পানি, মৎস্য সম্পদ সমুহ ও জীব বৈচিত্র ঝুঁকিতে পড়েছে। আরো অনিশ্চয়তায় পড়বে যদি দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। তাই আর চুপ করে বসে থাকলে হবে না। সবাইকে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়নে যে সমস্ত গ্যাস দায়ী আমাদের অসেচতন কর্মকান্ডে সে সমস্ত গ্যাস সম্মেলিত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিহার করতে হবে। উন্নত বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে গ্রীন হাউস গ্যাস উৎসারণ করে বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। বিশ্ব বাসিকে সুস্থভাবে বাচার জন্য আবহাওয়া, জলবায়ু ও বিশুদ্ধ বায়ু নিশ্চিত করতে হবে। তাই দায়ী উন্নত দেশগুলিকে এর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত বিশ্ব যাতে বিশ্বায়ন রোধে গ্রীন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে বাধ্য হয় তার জন্য ব্যাপক বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ও অভিঘাত মোকাবেলায় ভুক্তভোগী উন্নয়শীল দেশগুলিকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগীতা প্রদানে উন্নত দেশগুলিকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনে উদ্যোগী হতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক