বৃহস্পতিবার ● ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » তারুণ্যের অহংকার গৌরবোজ্জ্বল ইত্তেফাক
তারুণ্যের অহংকার গৌরবোজ্জ্বল ইত্তেফাক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতায় মিশে থাকা গৌরব উজ্জ্বল একটি নাম ইত্তেফাক। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আপোসহীন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এসেছে ইত্তেফাক। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটি যে ভুমিকা রেখেছে তা বাঙালি আজীবন মনে রাখবে। যার ধারাবাহিকতা আজো ধরে রেখেছে ইত্তেফাক।
নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ইত্তেফাক আজ গণমানুষের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের এই চর্চিত সময়ে নিজেদের সম্পাদকীয় নীতি থেকে শুরু করে পত্রিকার বিন্যাস, সবকিছুতে কমিটমেন্ট ধরে রাখা এক অগ্নীপরীক্ষা। যে পরীক্ষা ইত্তেফাক নিয়মিতই দিয়ে যাচ্ছে। যার ওপর পাঠকরা নির্ভর করতে পারে। ইত্তেফাক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মূল ভরসা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়, তার বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে ইত্তেফাকের পাতায়। তাই ইত্তেফাক প্রকৃত অর্থেই সমাজের দর্পণ। বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ‘আর্কাইভ’ ইত্তেফাক।
তরুণ প্রজন্মের কাছে আস্থা ও ভালোবাসা অপর নাম ইত্তেফাক। দেশের তরুণ প্রজন্মকে চিন্তাশীলতা ও মননশীলতার চর্চা করতে ইত্তেফাক কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইত্তেফাক আস্থা, সহনশীলতা, সাহস ও ভরসার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক সংবাদপত্রেরই একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন থাকে। এ সংবাদ মাধ্যমটি কখনোই কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার করেনি। সেদিক থেকে ইত্তেফাক সব সময়ই একটি উদারপন্থী সংবাদপত্র হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে আস্থার জায়গা করে নিয়েছে। সুসাংবাদিকতা এবং সত্য খবর হচ্ছে পত্রিকাটির মূল চালিকাশক্তি। তরুণ প্রজন্মকে একটি সুস্থ রাজনৈতিক দর্শন ও সঠিক ইতিহাস চর্চায় ইত্তেফাক সামনে থেকে কাজ করছে।
পত্রিকায় প্রাণ হচ্ছে তার সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়। আর তরুণরাও ইত্তেফাকের পাতায় তাদের লেখা প্রকাশ করতে পারছে। এভাবে ইত্তেফাক তরুণদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের বীজ বপণ করে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তরুণ সমাজকে লেখালেখির সুযোগ তৈরি করে দিয়ে ইত্তেফাক মুক্তবুদ্ধিচর্চার কান্ডারী হয়ে সাংস্কৃতিক মুক্তির আলোর মশাল জ্বালিয়ে যাচ্ছে। ইত্তেফাকের ‘নতুন প্রজন্মের ভাবনা’ পাতায় তরুণদের লেখার জন্য প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইত্তেফাকে ফিচার পাতাগুলোতেও রয়েছে তারুণ্যের আধিপত্য। দেশের সম্ভাবনাময় ও সফল তরুণদের কথা প্রকাশিত হচ্ছে। সাফল্যের গল্প অন্যসব তরুণদের আগামীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করছে। এছাড়া তরুণ সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চার জন্য ইত্তেফাকের পাতায় সাহিত্য নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে কবিতা, গল্প কিংবা সাহিত্য সমালোচনা। এ ভিন্নধর্মী পরিবেশনার কারণে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইত্তেফাক এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও ইত্তেফাকের অগ্রযাত্রা একই সূত্রে গাঁথা। তরুণ প্রজন্ম চিন্তাশীলতা ও মননশীলতার চর্চায় ইত্তেফাকের সেই শিকড়ের ইতিহাস খুজে তোলে। তরুণ প্রজন্ম এই ইতিহাস সংরক্ষণ করতে চায়।
ভাষা আন্দোলনের পর থেকে এ দেশে সংবাদপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে, পূর্ব বাংলার মানুষ বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই ভূখন্ডকে তাদের শোষণ-ভূমি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। বাংলার মানুষ তখন নিজের সংস্কৃতি, ভাষা অতীত ঐতিহ্য ইত্যাদির দিকে চোখ ফেরায়। আর এ কাজে রাজনীতি, সংস্কৃতির পাশাপাশি ইত্তেফাক হয়ে ওঠে আন্দোলনের হাতিয়ার। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে দৈনকি ইত্তেফাককেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় বারবার প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছে দৈনিক ইত্তেফাক।
ইত্তেফাক দেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন তো বটেই, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন সবকিছুতেই দৈনিক ইত্তেফাক সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে রাজনীতির পথনির্দেশ করেছে। মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক ধোঁকাবজি, রাজনৈতিক মঞ্চ আর রঙ্গমঞ্চ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, আওয়ামীলীগের বিপুল বিজয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ও ষড়যন্ত্র এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও সর্বাত্মক অসহযোগের আহ্বান থেকে ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হওয়া এই পুরোটা সময় দৈনিক ইত্তেফাক গৌরবময় ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে নতুন বাস্তবতায় দৈনিক ইত্তেফাক নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে থাকে। রাজনৈতিক মুখপত্রের বলয় থেকে বেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সাংবাদিকতা অগ্রসর হতে থাকে। সময়ের দাবি মেটাতে ইত্তেফাকের বিন্যাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু সত্য, ন্যায়, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো বদলায়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই দায়ভার বহন করে যাবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকটি সংবাদপত্র এদেশের আপামর জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও সীমাহীন ভালোবাসা অর্জন করেছে তাদের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক অন্যতম।
নানাবিধ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে ইত্তেফাক ৭১ বছরে পদার্পণ করে স-গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা ও চাহিদার বহিঃপ্রকাশ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায়। তাই সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিকল্প নেই। গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। প্রাচীনতম এই পত্রিকাটির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিকায়ন। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, শিল্প কিংবা সংস্কৃতি, সবকিছুতেই ইত্তেফাকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই এই পত্রিকা নানা ভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছে এবং এখনো অব্যাহত রয়েছে। যা আমাদের গর্ব। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় ইত্তেফাকের বিরল অবদান অতুলনীয়। ইত্তেফাক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একাত্তরেও তারুণ্যের গৌরবোজ্জ্বল ইত্তেফাক। এ ধারা অব্যাহত থাকবে, এই প্রত্যাশা ।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট