শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
শনিবার ● ১৩ জানুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন
২২০ বার পঠিত
শনিবার ● ১৩ জানুয়ারী ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন

                            প্রকাশ ঘোষ বিধান

বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্য ভরা এ বনের রয়েছে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন সঙ্কটাপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ,শিকার,গাছকাটা, সচেতনতার অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে বনের মূল্যবান প্রাণি ও সম্পদ।

সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বিশ্বে বিরল প্রজাতির বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসভূমি এই সুন্দরবনে। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ শতাংশ এবং মোট বনাঞ্চলের ৪৪ শতাংশ জুড়ে থাকা এ বনের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। মূল্যবান প্রানীজ, জলজ ও বনজ সম্পদ মিলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আঁধার। এই সুন্দরবন শুধু জীব বৈচিত্রের উৎস নয়, একই সাথে বন সংলগ্ন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকার উৎস হিসাবে অবদান রাখছে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কাঠ, মধু, মৎস, অন্যান্য বনজ সম্পদ আহরনের মাধ্যমে ৫-৬ লাখ মানুষ প্রায় সারা বছর জীবিকার জন্য সরাসরি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল।

জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় সুন্দরবন এখন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক ভ্রমণকেন্দ্র।  বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার ২ শত ৮০ বর্গ কিঃ মিঃ এর মধ্যে বাংলাদেশে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিঃ মিঃ।  বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবনের এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গর্বের। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে  সুন্দরবন গড়ে ওঠেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে। বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় সুন্দরবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের আধার ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে তিনটি অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। তিনটি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ওই বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার মোট আয়তন এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর।

সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ জলাভূমি। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। এ ছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এই জলভাগে ছোট-বড় ৪৫০টি নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে স্থলভাগ। সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনাপানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

সুন্দরবন শুধু বিশ্বের সেরা ম্যানগ্রোভ বন নয়। জীববৈচিত্র্যের আধার এ সুন্দরবন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের অংশ সুন্দরবন। এ বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশ্বের বাঘ প্রজাতির মধ্যে সুন্দর ও সেরা। মায়াবী চিত্রল হরিণের সাথে কোনো তুলনা হয় না। জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূল পরিবেশ, নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে শুধু বাঘ নয়, বনের সামগ্রীক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সাগরে পানির মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। ইতোধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মিঠাপানির কুমির।

সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সরকার মোট ২ শত ৯৫ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রতিবেশ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, বিজ্ঞান ভিত্তিক বন ব্যবস্থাপনা, ও উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। তবে গোটা সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের ১৮টি রাজস্ব অফিস, ৫৬টি টহল ফাঁড়িতে মোট জনবলের সংখ্যা ৮৮৯ জন। এই অপ্রতুল জনবল দিয়ে বিশাল এই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে দেখভাল করা  খুবই কঠিন কাজ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ  ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটছে বেশি। সুন্দরবনে বনদস্যু ও পশু শিকারিদের উপদ্রবও বাঘের অবাধ বিচরণ বাঘের নিরাপদ বংসবিস্তারের পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদনদীতে  জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেসওয়েল, ফ্লাই এ্যাশ, সিমেন্ট, কয়লা  সারসহ রাসায়িক দ্রব্যে  মারাত্মক পানিদূষণ হচ্ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার নদীর পানি দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে প্রাণিকূল ও বনজসম্পদ। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান  ক্ষতবিক্ষত হয়। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে অণুজীব থেকে শুরু করে বাঘ, হরিণ ও বনজীবীদের ওপর। বনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যায়। সুন্দরবনের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য,মাছ ও জলজপ্রাণীর প্রজননের অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এছাড়াও সুন্দরবনের পাশেই মোংলা সমুদ্র     বন্দরকে ঘিরে সুন্দরবনের আশপাশে ১৫৪টিরও বেশি বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠেছে। বিশেষ করে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিযে পরিবেশবাদীদরা  উদ্বিগ্ন। এটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটিও।

সারা বিশ্বে বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণী এখনো সুন্দরবনে টিকে আছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ বনে। বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মিঠাপানির কুমির,  মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক,  রাজগোখরা, কাছিম, ইরাবতী ও গাঙেয় দুই প্রজাতির ডলফিন, দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি। সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে বন মহিষ, দুই প্রজাতির গন্ডার, দুই ধরনের হরিণসহ অনেক প্রাণী।

বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবেও কাজ করে সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া যেকোনো ঝড়-ঝঞ্ঝায় সুন্দরবন নিজের বুক পেতে দিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষ্ করে।তবে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ওলবণাক্ততা। নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে।জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় দিতে হবে  অগ্রাধিকার। অবৈধভাবে প্রাণী শিকার বন্ধসহ  সুন্দরবনের সুরক্ষায় যত্নবান হতে হবে। দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার্থে সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা নাহলে ---প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনিবার্য। নিজেদের প্রয়োজনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)