বৃহস্পতিবার ● ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছে দিতে অনুবাদের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রকাশনার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছে দিতে অনুবাদের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রকাশনার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বৈশ্বিক মঞ্চে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের পাশাপাশি মুদ্রিত বইগুলোর ডিজিটাল প্রকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।
তিনি বলেন, “আমি সকল প্রকাশককে মুদ্রন প্রকাশনার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রকাশক হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। যাতে আমরা আমাদের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিশ্ব মঞ্চেও দ্রুত পৌঁছে দিতে পারি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে রেকর্ড ২১তম বারের মত মাসব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২৪’ এর উদ্বোধন কালে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
‘এখন আমাদের যুগটা হয়ে গেছে আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ,’ এই যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশ^ায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত।
“সেজন্য আমি আমাদের মাননীয় প্রকাশকদের অনুরোধ করবো এখন প্রকাশকদের শুধু কাগজের প্রকাশক হলেই হবে না, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে। কাজেই, ডিজিটাল প্রকাশক হলে এটা দ্রুত শুধু আমরা আমাদের দেশে না বিদেশেও সকলের কাছে পৌঁছাতে পারবো এবং অন্যান্য ভাষাভাষীরাও পড়বে,” বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কাজেই, সেদিক থেকে আমার মনে হয়, একটু মন মানসিকতার পরিবর্তন করে আধুনিক প্রযুক্তিটাও নিজেদের রপ্ত করতে হবে। লাইব্রেরিগুলোতে পড়ার জন্য থাকবে আবার অডিও ভার্সনটাও যেন থাকে। এটারও প্রয়োজন আছে। সেটা থাকলে অনেকের সুবিধা, শোনার মাধ্যমে জানতে পারবে। সেই ব্যবস্থাটাও আমাদের নেওয়া উচিত।
যদিও বই পাঠের আনন্দের অনেকটাই ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার মধ্যে থাকে না- সেকথার উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বইয়ের প্রকাশনা থাকবে কারণ একটি বই হাতে নিয়ে পাতে উল্টে পড়ার মধ্যে একটি আলাদা আনন্দ আছে। তবে, আজকালকার যুগে ছেলেমেয়েরা আবার ট্যাবে করে বই পড়ে, আবার, ল্যাপটপ বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের সাহায্যে বই পড়ে। যদিও আমরা তাতে মজা পাই না।
প্রধানমন্ত্রী অনুবাদ সাহিত্যের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে আমরা এগিয়ে যাব। আর অনুবাদ সাহিত্যে আমি বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাই-এক সময় অনেকে দাবি তুলেছিলেন অনুবাদ করা যাবে না কিন্তু আমি অনুবাদের পক্ষে। অনুবাদ যদি না হয় তাহলে এত ভাষা আমরা কোথা থেকে জানব। কাজেই, যেকোনো ভাষাকে অনুবাদ করে-এক একটা দেশকে জানতে হলে, জাতিকে জানতে হলে, সংস্কৃতিকে জানতে হলে-আমরা ভাষার মধ্যে দিয়ে জানতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বাংলা সাহিত্য যত বেশি অনুবাদ হবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীরা পড়ার সুযোগ পাবে। সেখানে আমি আরেকটা কথা বলব, যে এখানে বাংলা একাডেমি একটি আলাদা ওয়েব পোর্টাল তৈরি করে যত প্রকাশনা হয় সেগুলো ডিজিটালাইজড করে সেটা প্রচার করা এবং অন্যান্য ভাষার যাতে অনুবাদ হয় সে ব্যবস্থাটা করতে পারলে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আরও দ্রুত বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। সে ব্যবস্থাটা আমাদের করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগৃহীত রচনা: দ্বিতীয় খন্ড’ এবং ‘প্রাণের মেলায় শেখ হাসিনা’ (বাংলা একাডেমিতে শেখ হাসিনার গত ২০ বারের ভাষণের সংকলন) শীর্ষক দুইটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
এছাড়া উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৬ জনকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এ বছর ১১টি বিভাগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ প্রদান ককরা হয়। বিভাগগুলো হলো-: কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ/গবেষণা, অনুবাদ, নাটক, শিশুসাহিত্য বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, পরিবেশ/বিজ্ঞান ক্ষেত্র, জীবনী এবং লোক কাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন-: শামীম আজাদ (কবিতা), ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী (কথা সাহিত্য), জুলফিকার মতিন (প্রবন্ধ/গবেষণা), সালেহা চৌধুরী (অনুবাদ), নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক (যৌথভাবে নাটক ও নাট্য সাহিত্য), তপঙ্কর চক্রবর্তী (শিশু সাহিত্য), আফরোজা পারভিন এবং আসাদুজ্জামান আসাদ (মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণা), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং মো. মজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধুর উপর গবেষণা), পক্ষীবিদ ইনাম আল হক (পরিবেশ/বিজ্ঞান ক্ষেত্র), ইসহাক খান (জীবনী) এবং তপন বাগচী ও সুমন কুমার দাস (যৌথভাবে লোক কাহিনী)।
বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথা সাহিত্যক সেলিনা হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ পরিবেশিত হয় এপরপর ভাষা শহীদদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বইমেলা ঘুরে দেখেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল যেটা এখন করতে পেরেছে, আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। কাজেই, স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হবে সর্বক্ষেত্রেই। আমাদের স্মার্ট জনগোষ্ঠী হবে, স্মার্ট গভমেন্ট হবে, স্মার্ট ইকোনোমি হবে এবং স্মার্ট সোসাইটি হবে। এই স্মার্ট সোসাইটি করতে গেলে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের সাহিত্য এবং রচনাবলী অত্যন্ত প্রাণবন্তু এবং জীবনভিত্তিক এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। কাজেই, এগুলো আমরা যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব বাঙালি, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতি তত বেশি বিশ্বের দরবারে বিস্তার লাভ করবে। সবাই সেভাবেই কাজ করবেন সেটাই আমি চাই।
আগামীতে আরো আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের নিয়ে এসে বিশেষ করে বাংলা ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করেন তাদেরকে এনে আরো বর্ণাঢ্য সাহিত্য মেলা করার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
বইমেলায় আসতে পেরে খুব আনন্দিত সে কথার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসায় প্রাণের মেলার এই উচ্ছ্বাসে সেভাবে আগের মত আর মিশতে পারেন না, সে কথার উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, নিরাপত্তা বেষ্টনীর ঘেরাটোপে এভাবে মেলায় আসার কোন মজা নেই। কারণ, নিরাপত্তার বেড়াজালে স্বাধীনতাটাই হারিয়ে গেছে। এখানে আসলে মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা, স্কুল জীবনের কথা, এমনকি ’৮১ সালে দেশে ফিরতে পারার পর থেকে তিনি প্রতিবারই আসতেন। এই প্রাঙ্গণের সাথে তিনি এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেখানে এখন আর সেই স্বাধীনতাটা নেই। জানি না কবে আবার স্বাধীনতাটা পাবো, বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তবুও মানুষের জন্য যদি কাজ করতে পারি, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি-দারিদ্র্য বিমোচন করে মানুষকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ উপহার দেওয়া- সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা অনেক দূর এগিয়েও ছিলাম। করোনার কারণে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এরপর এখন আবার এসেছে ফিলিস্তিনের উপর আক্রমণ। এইসব কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং অর্থনৈতিক চাপ রয়ে গেছে সব জায়গায়। তার থেকে বাংলাদেশও দূরে নয়। তারপরেও আমরা আমাদের দেশটাকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি এবং এগিয়ে যাব। ইনশাআল্লাহ এই বাংলাদেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, সেভাবেই আমরাই দেশকে গড়ে তুলবো। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধি পাবে। এখন জেলায় জেলায় বইমেলা হচ্ছে পর্যায়ক্রমিকভাবে আমরা আমাদের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বইমেলা নিয়ে যাব। যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
কোমলমতি শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে সরকার প্রধান বলেন, বই পড়ার অভ্যাসটা সকলের থাকা উচিত। এটা বাবা মা যদি ছোটবেলা থেকে শেখায় তাহলেই কিন্তু এই বই পড়ার অভ্যাসটা হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ’৯৬ থেকে ২০০১ পরবর্তী মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে না পারায় বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার পাদপিঠ হয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ যে খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন- সে কথারও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দ্বিতীয়বার যখন আমি সরকারে আসি, সেটা প্রতিষ্ঠা করি। এখন সেখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে, অনেক ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে সেখানে জানা যায়। এটা যেন আরও সমৃদ্ধ হয়, সেটা আমি চাই।”
তিনি তাঁর সরকারের অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এর স্বীকৃতি এনে দেওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় কানাডা প্রবাসী রফিক এবং সালামসহ ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ নামের সংগঠনের অবদানের কথাও স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, “রক্তের অক্ষরে আমরা যে মাতৃভাষার অধিকার আদায় করেছি সেটা বিশ^ব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ ভাষা দাবি দিবসের ধর্মঘট চলাকালে তিনি গ্রেপ্তার হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ কওে তিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন জানিয়ে জাতির পিতার কন্যা বলেন, বাবার পথ অনুসরণ করে এ পর্যন্ত যত ভাষণ দিয়েছি। অন্তত ১৯-২০ বার হবে। আমি কিন্তু প্রতিবার বাংলায় ভাষণ দেই।
তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ’৭৪ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি দেওয়ার পর প্রথম সেখানে ভাষণ দিতে যান তখন তিনি বাংলাতেই ভাষণ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। রবি ঠাকুর যেমন তার কবিতার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে এসেছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বক্তব্যের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তাঁর যে বক্তব্য সেটাই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।(বাসস)