বুধবার ● ১ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ ও চূড়ান্ত নয়
সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ ও চূড়ান্ত নয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
সাংবাদিকতা সম্মানজনক একটি পেশা। এ পেশায় সততা ও দায়িত্বশীলতা প্রথম ও প্রধান কথা। জনজীবনে গণমাধ্যমের প্রভাব অপরিসীম। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত। গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনের নিরন্তর সহযোগী।মুক্ত গণমাধ্যম গণতন্তের জন্য অপরিহার্য। কাজেই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ ও চূড়ান্ত নয়, শর্তযুক্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অপসাংবাদিকতা ও অপরাধমূলক কাজকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। বাকস্বাধীনতার নামে ইচ্ছাখুশি সবকিছু করা যাবে না। কারণ, বাকস্বাধীনতার সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা সরকারকে হেয় ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে নিয়ে বিতর্কিত করে। অনেক সংবাদপত্র মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করছে। অসত্য সংবাদ পরিবেশন করেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। অনলাইন সংবাদপত্রসমূহের অনেকে আজগুবি, বানোয়াট উদ্দেশ্যমূলক ও নির্লজ্জ মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন কর্ হচ্ছে। অসৎ সাংবাদিকরা এমন ভিত্তিহীন মনগড়া নিউজ করায় মানুষকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রকে বিভ্রান্ত করছে। আর বাকস্বাধীনতার নামে ফেসবুক লাগামহিনভাবে ছুটছে। অশ্লীল, বিকৃতছবি, কুরুচিপূর্ণ লেখায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। প্রতি বছর ৩ মে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এই দিবসটিতে।
বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবস বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আধুনিক সমাজে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, তাঁদের সুরক্ষা, সংবাদ সংগ্রাহকদের সুরক্ষা, সংবাদ পরিবেশনে বাধা, ভয় দেখানো বা এমন কোনও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিতেই এই বিশেষ দিন বেছে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালে এই দিনটিতে আফ্রিকায় নামিবিয়ার সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি নীতি-নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছিল। ওই দিনটিকে স্মরণ করা হয় পালন করা হয় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস।
১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় (৩ মে) তারিখটিকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে অথবা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেয়া হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং অধিকারকে সম্মান ও সমুন্নত রাখার জন্য সরকারকে তাদের কর্তব্য মনে করিয়ে দেয়।
জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে: প্রত্যেকের মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা, এবং কোনও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য ও ধারণাগুলি অনুসন্ধান করা, গ্রহণ এবং গ্রহণের স্বাধীনতার সীমানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের সংবিধানের দণ্ডবিধি আইনের ৫২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও কাজ অপরাধী মন নিয়ে ও ইচ্ছাকৃতভাবে না করলেও তা অপরাধ হতে পারে যদি তা যথাযথ সাবধানতা ও মনোযোগ সহকারে করা না হয়। ন্যায়নিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন সাংবাদিকতা করছে। অনেক ক্ষেত্রে একপেশে, একদেশদর্শী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ আর ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে বাক-স্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়, বরং শর্তযুক্ত। ১৯(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এ ধারার (২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রয়োগের সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অতএব, এসব অধিকারের ওপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে।
সাংবাদিকদের ওপর অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত হামলার ঘটনা প্রতিকারহীনভাবেই ঘটে চলেছে। প্রতি বছরই হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় যে তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। তারা তাদের অপকর্ম ঢেকে দিতে চাইছে পেশিশক্তি আর গলাবাজী করে। এ অবস্থার প্রতিকার দরকার। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর ভুমিকা নেওয়া উচিত। কারণ কোনো পেশিবাজ আজ আছে, কাল তার পেশিশক্তি নাও থাকতে পারে। কিন্তু সাংবাদিকদের কলম, ক্যামেরা জাতির পক্ষে আছে, থাকবে। সাংবাদিকদের এমনিতেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়। শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করতে হয়। তুষ্ট করতে না পারলে নেমে আসে নির্যাতন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়।
ইউনেস্কোর মতে, সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা শুধু সাংবাদিকদের নয়, এটি সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়। এটি মানবাধিকারের অগ্রগতির মূল বিষয় এবং শক্তিশালীদের জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক কাজ। সাংবাদিকরা যেসব তথ্য প্রদান করেন তা জনসাধারণেরই জন্য, তাই তাদের প্রতি জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন।
তথ্য হচ্ছে একটি গণসম্পদ। ভুল তথ্য এবং অপপ্রচাররোধে মুক্ত এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। জাতিসংঘ সাংবাদিক নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা। অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক প্রচার মাধ্যমকে কঠোরভাবে আঘাত করেছে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ। আর বাজেট সংকটের কারণে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়াও কঠিন হচ্ছে। একারণে গুজব, মিথ্যা এবং চূড়ান্ত বা বিভাজিত মতামত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব সাংবাদিকরা ধনী নন।তারা বড় অংকের টাকা কামাই করেন না। তাই সাংবাদিকদের সমৃদ্ধ জীবনমান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যা নিশ্চিত করা না হলে গণমাধ্যমের বিকাশ ও শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব না।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট