শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
রবিবার ● ১২ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » প্রকৃতির জন্য মৌমাছি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
প্রথম পাতা » মুক্তমত » প্রকৃতির জন্য মৌমাছি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
১৯২ বার পঠিত
রবিবার ● ১২ মে ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

প্রকৃতির জন্য মৌমাছি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

প্রকৃতির জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। মৌমাছি বা মধুমক্ষিকা বা মধুকর  বোলতা এবং পিঁপড়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গবিশেষ। মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়ণের জন্য প্রসিদ্ধ। পৃথিবীতে ৯টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় কুড়ি হাজার মৌমাছি প্রজাতি আছে, যদিও এর বেশিরভাগেরই কোন বর্ণনা নেই এবং এর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। আন্টার্কটিকা ব্যতীত পৃথিবীর সকল মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ-পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে, সেখানেই মৌমাছি আছে।দেশে সচরাচর চার প্রকার মৌমাছি দেখা যায়।রকি বা পাহাড়ি মৌমাছি, লিটল বী বা ক্ষুদে মৌমাছি,ইণ্ডিয়ান বী বা ভারতীয় মৌমাছি ওইউরোপিয়ান বী বা ইউরোপিয় মৌমাছি। এগুলি ছাড়াও কেরলে আর একটি প্রজাতি পাওয়া যায় যারা “হুলবিহীন মৌমাছি” নামে পরিচিত৷ এরা আদৌ হুলবিহীন নয়, প্রকৃতপক্ষে এদের হুল পূর্ণ বিকশিত হয় না৷ তবে এরা খুব ভালো পরাগসংযোজক৷ এরা বছরে ৩০০-৪০০ গ্রাম মধু উৎপাদন করে।

যেখানেই সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে, সেখানেই দেখা মিলবে মৌমাছির। এরা অত্যন্ত কর্মঠ ও বুদ্ধিমান। কারণ মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণে গাছে ফুল ফোটে, ফল হয়। মৌমাছির মতো কীটপতঙ্গ না থাকলে গাছে ফুল ফুটত না, ফল হতো না। প্রায় ৯০ ভাগ বন্য উদ্ভিদে পরাগায়ন ঘটায় মৌমাছি।

বিশ্ব মৌমাছি দিবস ২০ মে পালিত হয়। ১৭৩৪ সালের এই দিনে মৌমাছি পালনের প্রবর্তক আন্তন জানসা জন্মগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক দিবসের উদ্দেশ্য হল বাস্তুতন্ত্রের জন্য মৌমাছি এবং অন্যান্য পরাগায়নকারীদের ভূমিকাকে স্বীকার করা। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি ডিসেম্বর ২০১৭ সালে ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসাবে ঘোষণা করার জন্য স্লোভেনিয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তখন থেকে এ তারিখে দিবসটি পালন করা হয়।

মৌচাক হলো মৌমাছির আবাসস্থল। এটি তৈরী হয় মোম জাতীয় পদার্থ দিয়ে। মৌচাকে ক্ষদ্র ক্ষুদ্র ষড়ভূজ প্রকোষ্ঠ থাকে। মৌমাছি এসব প্রকোষ্ঠে মধু সঞ্চয় করে। এছাড়া ফাঁকা প্রকোষ্ঠে মৌমাছি ডিম পাড়ে, লার্ভা ও পিউপা সংরক্ষণ করে। মৌমাছি নিজেই দেহাভ্যন্তরে মোম তৈরী করে।শ্রমিক মৌমাছির’ দেহে আটটি ক্ষুদ্র গ্র্যাণ্ড থেকে মোমশ্বল্ক নি:সৃত হয়। নি:সরণের সময় মোমশ্বল্ক থাকে স্বচ্ছ যা কালক্রমে সাদা ও পরে ঈষদচ্ছ বর্ণ ধারণ করে। সহস্রাধিক মোমশ্বল্ক থেকে এক গ্রাম মোম পাওয়া সম্ভব।

মৌমাছিরা দলবদ্ধভাবে উপনিবেশে বাস করে। প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে৷একটি চাকে বা দলে থাকে তিন ধরনের মৌমাছি। রানী মৌমাছি, শ্রমিক মৌমাছি ও পুরুষ মৌমাছি। রানী মৌমাছি দলের নেতা ও আকারে সবচেয়ে বড়। সম্পূর্ণ দলকে গাইড করার পাশপাশি পরবর্তী রানী মৌমাছি জন্ম দেওয়া তার কাজ। শ্রমিক মৌমাছিদের কাজ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা এবং নিজেদের চাক বানানো। সব শ্রমিক মৌমাছিই নারী। এই শ্রমিক মৌমাছিগুলোকেই আমরা বাইরে উড়তে দেখি। আর পুরুষ মৌমাছির কাজ রানীর আশেপাশে থাকা। তবে গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল ছাড়া বাকি মৌসুমে পুরুষ মৌমাছিরা অলস সময় কাটায়।রানী মৌমাছি বাঁচে গড়ে পাঁচ বছর। গ্রীষ্মকালে রানী মৌমাছি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। এ সময় প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ডিম পাড়ে রানি মৌমাছি। রানী মৌমাছি মারা গেলে শ্রমিক মৌমাছিরা সদ্য জন্মানো একটি রানী মৌমাছিকে বাছাই করে। তাকে রয়্যাল জেলি নামে একধরনের বিশেষ খাবার খাওয়ানো হয়। ফলে দ্রুত বড় হতে থাকে মৌমাছিটি। এটিই প্রাপ্তবয়স্ক হলে রানী মৌমাছির জায়গা দখল করে।

মৌমাছি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার মধুর জন্য। কিন্তু এই মধু আমাদের জন্য তৈরি করে না মৌমাছিরা। বরং শীতকালে নিজেদের খাওয়ার জন্য তারা মধু সংগ্রহ করে রাখে। প্রয়োজনের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি মধু উৎপাদন করে রাখে এরা। আর সুযোগ বুঝে সেই অতিরিক্ত মধুই আমরা নিয়ে নিই। মৌমাছি গড়ে এক থেকে দেড় মাস বাঁচে। এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি মৌমাছি প্রায় ১/১২ চা চামচ মধু সংগ্রহ করে। যা প্রায় ০.৮ গ্রামের সমান।

মৌমাছির চাকের গঠন ষড়ুভুজাকার হওয়ায় গবেষকেরা ভাবতেন, মৌমাছি বুঝি জ্যামিতি জানে৷ বিস্ময়কর ভাবে গবেষণা করে দেখা গেছে মৌমাছিরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারে৷  মৌমাছিও কিন্তু অঙ্ক কষতে পারে। মৌমাছির চাকের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন। এদের চাকের ভেতরে থাকে মধু রাখার ছোট ছোট কুঠুরি। কুঠুরিগুলো ষড়ভূজাকার। এই জ্যামিতিক আকৃতির কুঠুরিতেই সবচেয়ে বেশি মধু রাখা যায়। ষড়ভূজাকার না হয়ে বৃত্তাকার বা গোলাকার হলে এত মধু ধরতো না।

মৌমাছিরা ঘন্টায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। এদের দুই পাশে দুটি করে মোট চারটি ডানা থাকে। সেকেন্ডে ২৪০ বার ডানা ঝাপটায় এরা। মৌমাছি ক্ষুধার্ত থাকলে দিনে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। তবে সাধারণত এরা চাকের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে।মৌমাছির প্রায় ১৭০টি গন্ধ নেওয়ার রিসেপ্টর আছে। গন্ধ শুকে তারা বাসায় ফিরতে পারে। খাবারের সন্ধানে গিয়ে ফুল চিনতেও সাহায্যে করে এই রিসেপ্টর।

মৌমাছির হুল ফুটানো বিষ খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু মৌমাছির হুল থেকে সংগৃহীত বিষ রোগ নিরাময়ের উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে বলে গবেষকরা দাবী করেছেন। নিউজিল্যান্ডের নেলসন হানি এন্ড মার্কেটিং নামীয় একটি কোম্পানি জানিয়েছে, গেঁটে বাতজনিত ব্যথা নিরাময়ে প্রদাহ নিরোধক হিসাবে কাজ করে মৌমাছির বিষ।

বাংলাদেশে পরাগরেণু ও সুধার উৎস হিসেবে বিচিত্র রকমের উদ্ভিদ রয়েছে। এ দেশের অনুকূল আবহাওয়ায় মৌমাছি সারা বছর এসব উদ্ভিদ থেকে খাদ্য আহরণ করে জীবন চক্র অব্যাহত রাখতে পারে। বাংলাদেশে বার্ষিক ৩০ হাজার মেট্রিক টন মধুর চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার মেট্রিক টন। আমাদের দেশে উৎপাদিত মধুর শতকরা ৭৫ ভাগ আসে সুন্দরবন থেকে। সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য বনাঞ্চলের সপুষ্পক উদ্ভিদে সুধা ও পরাগরেণুর অবারিত উৎস রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি চাষ করে মধু, মোম, মৌকাই , রাজচিত মোরব্বা রস, পরাগরেণু  ও গরল সংগ্রহ ও বিক্রি করে অর্থ উপার্জন  এবং মৌকলোনীর মাধ্যমে ফসলের পরাগায়নে ব্যবহার করে ফসলের অধিক ফলন প্রাপ্তি সম্ভব।

প্রায় ৩ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে মৌমাছি টিকে আছে। প্রতিটি মৌমাছির চাকে গড়ে ৫০ হাজার মৌমাছি থাকে। ১ কেজি মধু সংগ্রহ করতে প্রায় ৪০ লাখ ফুলে ঘুরতে হয় মৌমাছিদের। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমের ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ণ ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ফল। এভাবে মৌমাছিরা পরাগায়ণের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে ফল ও ফসলের উৎপাদন বাড়ায়। আমাদের দেশে সরিষা, পেঁয়াজ, ধনে, গুয়ামৌরী, কালোজিরা, লিচু, বড়ই, তুলা প্রভৃতি ফসলের জমিতে মৌকলোনী স্থাপন করে এসব ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মৌকলোনীর উপজাত সংগ্রহ ও বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও টেকসই জীবিকার জন্যও মৌমাছি পালন করা দরকার। মৌমাছি সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, প্রকৃতি থেকে মৌমাছি উধাও হলে মানবজাতি সর্বোচ্চ চার বছর টিকে থাকতে পারবে। এ উদ্ধৃতি থেকেই বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণে মৌমাছির গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। মৌমাছি পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা দানের মাধ্যমে দেশের ফল ও ফসলের উত্পাদনে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দান করা যায়। কিন্তু কৃষিজমিতে অতিবিষাক্ত ও মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার, কৃষিজমি ও বনভূমি হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এক ফসলি চাষ মৌমাছির প্রাকৃতিক আবাসস্থল, স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজননে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। প্রকৃতির জন্য মৌমাছি সংরক্ষণ  অত্যন্ত জরুরি।

লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)