শনিবার ● ২২ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » রাসেলস ভাইপার নিয়ে বিভ্রান্তি, ভয় ও উদ্বেগ
রাসেলস ভাইপার নিয়ে বিভ্রান্তি, ভয় ও উদ্বেগ
প্রকাশ ঘোষ বিধান
দেশের বেশ কিছু জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে অনেকে নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকে প্রচার করছেন যে, সাপটি কামড় দিলে দ্রুত মানুষের মৃত্যু হয়। রাসেল’স ভাইপার নিয়ে যেভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে দেশের সব জেলায় জেলায় রাসেল’স ভাইপার সাপে ভরে গেছে। অতি উৎসাহের প্রচারণায় শুধুমাত্র আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।চন্দ্রবোড়া বিষয়ক সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত সংবাদ যে হারে প্রচার ও শেয়ার হচ্ছে তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নাই। গুজব সত্যের চেয়ে বেশি বেগে চলে। রাসেল’স ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা ছড়ানো হচ্ছে তার অধিকাংশ ভূলে ভরা তথ্য দিয়ে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, রাসেলস ভাইপার সাপ মেরে ফেরার প্রচারণাও চালানো হচ্ছে ফেসবুকে। এমন অবস্থায় ফরিদপুরের একজন রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, রাসেলস ভাইপার সাপ মারতে পারলে প্রতিটির জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
রাসেল’স ভাইপার ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ। বাংলাদেশে এটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। সাপটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এই সাপে দংশনের ঘটনার প্রমাণ দেখা যায়। ইদানিং এর উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কারণে এটা নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে।
চন্দ্রবোড়ার নাম সেই ছোটকাল থেকে শুনি। উপকূল এলাকার বিলে চাষাবাদ করার সময় চন্দ্রবোড়া দেখা যেত। গরুর লাঙ্গলে চাষ করার সময় লাঙ্গলের ফলায় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা চন্দ্রবোড়া বের হয়ে আসতো। তথন উপকূল এলাকায় প্রচুর চন্দ্রবোড়া দেখা যেত। তবে আশির দশকে উপকূলের খুলনা,সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট এলাকার বিলে লবন পানি তুলে চিঙড়ি চাষ শুরু হলে চন্দ্রবোড়া সাপ কমতে থাকে। এক সময এলাকা থেকে চন্দ্রবোড়া বিলুপ্ত হয়।
রাসেলস ভাইপার স্থানীয়ভাবে চন্দ্রবোড়া ও উলুবোড়া নামেও পরিচিতি। সাপটি দেখতে অনেকটা অজগরের বাচ্চার মতো। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে কাজ করতে এসেছিলেন স্কটিস সার্জন প্যাট্রিক রাসেল। ১৭৯৬ সালে তিনি এই সাপ সম্পর্কে গবেষণা করেন। তার নাম অনুসারে এই সাপের নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ঘোষিত বিলুপ্ত এই সাপটি মূলত শুষ্ক অঞ্চলের, বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা হলেও এখন তা দেশের অন্তত ২৫টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পৌঁছে গেছে উপকূলীয় অঞ্চল বরিশাল, পটুয়াখালী ও চাঁদপুর পর্যন্ত। আর প্রায়ই এসব এলাকা থেকে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যুর খবর আসছে, যাদের বেশিরভাগ দরিদ্র কৃষক ও কৃষিশ্রমিক।
এখন যে সাপের সংখ্যা বেড়ে গেল এর কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হলো, এই সাপটি বাচ্চা দেয়। ডিম পাড়ে না। তাই এদের বেঁচে থাকার হারটা বেশি। ডিমে বেঁচে থাকার হারটা একটু কম হয়। তাছাড়া, একটি স্ত্রী রাসেলস ভাইপার একবারে তিন থেকে ২০টি, এমনকি ৭০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়, যার বেশিরভাগই বেঁচে থাকে। সাপটি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এটিও একটি কারণ। আবার বর্ষার ঢলে উজান থেকে আসা পানিতে কচুরিপানার ওপর ভেসে কিছু সাপ বাংলাদেশে আসছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দিকে পদ্মা যেখানে বাংলাদেশে ঢুকেছে, ওইদিককার ঝোপঝাড়গুলো কিছু জায়গায় কেটে ফেলা হয়েছে। যে কারণে পদ্মার অববাহিকা ধরে নামতে নামতে শরীয়তপুর পর্যন্ত চলে গেছে এই রাসেলস ভাইপার। এরা মূলত বাচ্চা কিংবা বড় অবস্থায় কচুরিপানায় করে আসে। এসে চরে কিংবা ডাঙায় ভিড়ে যায়। আবার কোনো কারণে যদি প্রাকৃতিক শিকারি, যেমন বেজির সংখ্যা কমে যায় তাহলে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু এই সাপ মূলত ইঁদুর এবং ইঁদুর গোত্রের প্রাণী খেয়ে থাকে, তাই ইঁদুরের সংখ্যা বাড়লেও রাসেলস ভাইপারসের সংখ্যাও বাড়ে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে এই সাপ আগে থেকেই ছিল। ওই অঞ্চলে আগে বছরে একটা ফসল হতো। এখন দুটো-তিনটা ফসল হয়। বেশি ফসল হওয়ার কারণে দেখা যায় সেখানে ইঁদুর বেশি থাকে। আর এই ইঁদুর হলো রাসেলস ভাইপারের প্রধান খাদ্য। উপমহাদেশের পরিচিত সাপ হলেও গত এক দশক আগেও মনে করা হতো সাপটি এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এর আধিক্য থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আগে বন, জঙ্গল, ঝোপে সাপটির অস্তিত্ব অত্যাধিক হলেও বাসস্থান বিলোপের কারণে ইদানিং ধানক্ষেতে অনেক কৃষক সাপটির কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য রাসেল ভাইপারের ৪০ গ্রাম বিষই যথেষ্ট। তবে রাসেল ভাইপার প্রতিটি কামড়ে ২৫০ থেকে ২৬০ গ্রাম পর্যন্ত বিষ ছাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, হিসেবে ২০২৩ সালে চার লাখ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে যাদের বেশিরভাগই কোবরা ও কেউটে প্রজাতি সাপের কামড়ের শিকার হয়েছেন। গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবু সাইদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেছেন, রাসেলস ভাইপার নিয়ে যেভাবে আতঙ্কের কথা বলা হচ্ছে সেটি নিতান্তই ভয় থেকে এবং এটি অতিরঞ্জিত। রাসেলস ভাইপার মোটেও দেশের সবচেয়ে বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী সাপ নয়। বরং দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত লোক মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় কেউটে সাপের কামড়ে। তবে সময়মত চিকিৎসা না নিলে রাসেলস ভাইপারের কামড়েও মৃত্যু হতে পারে।
সাপ গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ প্রজাতির সাপ কামড়ালে তারও চিকিৎসা আছে এবং সময়মত চিকিৎসা নিতে পারলে মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে। অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, অনেকে না জেনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সাপ দেখে সবাই ভয় পায় এবং এর কামড়ে মারা যায় এটাই মনে গেঁথে গেছে। চিকিৎসা নিলে যে ভালো হয় সেটা সবাই জানেনা বলেই আতঙ্ক হয়। খুব দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেই সমাধান অনেকটা এগিয়ে নেয়া যায়। রাসেল’স ভাইপার কামড়ালে একশ মিনিটের মধ্যে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারলে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়।
এ সাপের আক্রমণে আতঙ্কে দিন পার করছেন জনসাধারণ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিস্তারিত তুলে ধরেছে বাংলাদেশ বনবিভাগ। বনবিভাগ বলেছে, ওই গত ১০ বছর আগেও এই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার তেমন চোখে পরত না। মূলত ২০১২ সালের পর থেকে এই সাপের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।
বিভিন্ন কারণে সাপের থাকা ও খাবার সংকট তৈরি হয়েছে। আবার কিছু এলাকায় জমিতে এখন একাধিক ফসল হওয়ায় শিয়াল, খাটাশ, বেজি, গুইসাপ আর নেই বললেই চলে। এর ইকোসিস্টেমটাই নষ্ট হয়ে গেছে, আবাস থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা এখন কচুরি পানায় ভেসে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় ভেসে ছড়াচ্ছে।
রাসেল’স ভাইপার স্বভাবগতই কিছুটা তেজী। এটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে চলে যায়, ফলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। এই সাপটির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত মানুষ হিসেবে আমরাই দায়ী। যেসকল প্রাণী রাসেলস ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, প্রকৃতিতে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। কিছু সাপ যেমন, শঙ্খচূড়, খইয়া গোখরা, কালাচ বা কেউটে, শঙ্খিনী রাসেলস ভাইপারসহ অন্যান্য সাপ খেয়ে থাকে। বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল এরাও রাসেল’স ভাইপার খেয়ে থাকে।
এছাড়া তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এই সাপ খেতে পারে। বন্যপ্রাণী দেখলেই তা নিধন করার প্রবণতা, কারণে অকারণে বন্যপ্রাণী হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের সর্বত্রই এসকল শিকারি প্রাণী আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে রাসেলস ভাইপার অত্যধিকহারে প্রকৃতিতে বেড়ে গেছে।রাসেল’স ভাইপার নিঃসন্দেহে বিষধর সাপ তবে বাংলাদেশে এন্টিভেনম আছে এবং সাপও নিধন হচ্ছে। রাসেল’স ভাইপার কামড় দিলে নিশ্চিত মৃত্যু এটা সত্য নয়। বেজি এবং গুইসাপ আমরাই হত্যা করে সাপের বংশ বাড়াতে সুযোগ দিয়েছি। তবে দেশে প্রতিবছর মশার কামড়ে যে সংখ্যক মানুষ মারা যায় তার মাত্র ৩ ভাগ মানুষ মারা যায় সব সাপের ছোঁবলে। আতঙ্কিত না হয়ে অপপ্রচারকে নিরুৎসাহিত করি।
কাউকে যেকোন ধরনের সাপে কামড়ালে ওঝা এবং বৈদ্যের কাছে না নিয়ে যথা দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিলে দূর্ঘটনার মাত্রা কমে আসবে। অসচেতনতার কালে মানুষ জা’ত সাপের দংশনেও মারা যেতো। কাজেই হুজুগে কৃষি এবং কৃষক যেনো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রাসেল’স ভাইপার বিষয়ে সচেতনতা মূলক প্রচারণা হোক। অপপ্রচারে আতঙ্ক ছড়ায়।আমরা সবাই সতর্ক হই। অপ্রয়োজনীয় আতঙ্কের কোন কারণই নেই। তবে সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট