মঙ্গলবার ● ৯ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » বিশেষ সংবাদ » দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘাপটি মেরে থাকা চরমপন্থীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘাপটি মেরে থাকা চরমপন্থীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে
উপকূল এলাকার জেলাগুলিতে ঘাপটি মেরে থাকা চরমপন্থীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থীরা সক্রিয় হতে চায়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর একে অভিযানে কিছুদিন পালিয়ে থাকলেও অভিযানে শিথিলতার সুযোগে ফিরে আসছে অনেকেই। তারা মৎস্য ঘের দখল, জমি দখলসহ চাঁদাবাজি করছে। ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদার, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই পরিচিত নম্বর ছাড়া ফোন রিসিভ করতে ভয় পাচ্ছেন।
গত ২৮ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। ৬ জুলাই শনিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে শরফপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৮ জুলাই সোমবার রাত ১০টার দিকে নগরের পূর্ব বানিয়া খামার লোহার গেট এলাকায়খুলনা নগরীতে আল আমিন (৪৫) নামের যুবলীগের এক সাবেক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা হয়।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় বিগত ৪৫ বছরে ৭ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে। সর্বশেষ ডুমুরিয়া উপজেলার সরাপপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম রবি সন্ত্রাসীদের গলিতে নিহত হন। রবিউলের আগে সর্বশেষ ২০০১ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কবিরুল ইসলাম নিহত হন। ২০০১ সালে নিহত কবিরুলের বাবা ছিলেন কামাল উদ্দিন। ১৯৮৬ সালে সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামাল উদ্দিনকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালে গুটুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খান আলমগীর হোসেন ভারতে সফরে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে ডুমুরিয়ায় তৎকালীন খর্নিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মোকছেদ আলীকে প্রথম গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৮৯ সালে সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল মজিদ ও ১৯৯৯ সালে রুদাঘরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোজাম সরদারকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
চরমপন্থী-সন্ত্রাসীদের এমন আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সন্ত্রাস-কবলিত খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আবারও হানাহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার মানুষ নতুন করে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সে সাথে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৮০’র দশকের পর থেকেই মূলত তৎপরতা দেখা যেত, বাম সংগঠনের আদর্শধারী চরমপন্থী সংগঠনগুলোর। নিজেদের মধ্যে আধিপত্যের বিরোধে জড়িয়ে দলের ভেতরেই চলত হত্যা-পাল্টা হত্যা। কয়েক বছরে নিজেদের মধ্যে ভাঙন ও কোন্দলে জড়িয়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হতে থাকে সংগঠনগুলো। বাড়তে থাকে খুনোখুনি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় কিছু সন্ত্রাসী আত্মসমর্পণ করলেও কিছুদিন পর পরিস্থিতি ফের পাল্টে যায়। ২০০১ সালের পর দক্ষিণ-পশ্চিশাঞ্চলের ১০ জেলায় তৎপর হয়ে ওঠে ১০টি চরমপন্থী সংগঠন। সেই সময় চুয়াডাঙ্গাসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় প্রায় প্রতিদিনই নৃশংসভাবে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটতে থাকে। একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম অসহায় হয়ে পড়ে। বিষয়টি খোদ সরকারকেও ভাবিয়ে তোলে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০০৪ সালে মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। চরমপন্থী-সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের জন্য শুরু হয় বিশেষ অভিযান। পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে পতন হতে থাকে শতাধিক চরমপন্থী ক্যাডারের। পরিস্থিতি ক্রমেই উন্নতি হতে থাকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় দাদা তপন, আবির হাসান, দাদা মৃণাল, একদিল, টিক্কা, শোয়েব, সুমন, আকাশসহ বাঘা বাঘা সন্ত্রাসীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে টিকতে না পেরে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় চরমপন্থী দলের শীর্ষ ক্যাডাররা। অনেকে ভারতেও পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলাতে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়ানো চরমপন্থী-সন্ত্রাসীরা নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ফেরা শুরু করেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বেশ কিছুদিন ধরে ভারতে থেকে এসে নিজ এলাকাতেই অবস্থান নিয়েছে বলে ওই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে। কেউ কেউ আবার জামিনে মুক্ত হয়ে নতুন করে তৎপরতা শুরু করার চেষ্টা করছে।মোটা অংকের টাকার হাত বদল ও ভবিষ্যতে স্থানীয় ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণসহ হাট বাজার,খাস খাল ও ঘের দখলের সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় এসব চরমপন্থী প্রকাশ্যে মাঠে নামে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় এক ডজন চরমপন্থী সংগঠনের অস্তিত্ব ছিলো। এদের মধ্যে গণমুক্তি ফৌজ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, এমএল জনযুদ্ধ, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএল লাল পতাকার আধিপত্য ছিলো। ঘাপটি মেরে থাকা এসব সংগঠণের চরমপন্থীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দাদা মৃণাল পাকগাছাসহ উপকূলের ত্রাস ছিলে। তার অনুসারিরা এখনো ঘাপটি মেরে আছে বলে জানা গেছে। উপকূলের উপজেলাগুলিতে জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্ঠজনদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আবার যে কোন সময় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ছুঁড়া গুলিতে প্রাণ যেতে পারে এমন আতঙ্কে এ জনপদের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।