মঙ্গলবার ● ৩০ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » চিত্রবিচিত্র » বিয়ে না করে ৩৬ বছরের বন্ধুত্ব ছরোয়ার ও শ্যামলের
বিয়ে না করে ৩৬ বছরের বন্ধুত্ব ছরোয়ার ও শ্যামলের
শাহীন আলম তুহিন ,মাগুরা থেকে : বিয়ে না করে ৩৬ বছর ধরে বন্ধুত্ব করে বজায় রেখে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালী ইউনিয়নের গোলাম ছরোয়ার (৫৫) ও শ্যামল দত্ত (৫৪) । দু’জনের একজন মুসলমান ও অন্যজন হিন্দু । দুজনের এ দীর্ঘ বন্ধুত্ব নিয়ে এলাকায় সব বয়সী মানুষের মুখে মুখে প্রশংসিত । ১৯৮৮ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বাবুখালি আফতাফ উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । সেই সময়ে থেকে এখন পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব রয়েছে অটল । এক বন্ধু একদিন না দেখে অন্যকে ছেড়ে থাকতে পারে না। দুই বন্ধরু পারিবারিক বন্ধনও সু সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে । দু’পরিবারের সবাই তাদের এ বন্ধুত্ব পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াইনি । তাদের সম্পর্ক যাতে আরো অটুট থাকে সেই জন্য তাদের সহযোগিতা করেছে দুই পরিবার । গোলাম ছরোয়ারের বাড়ি মহম্মদপুরের বাবুখালি ইউনিয়নের বাশো গ্রামে এবং একই ইউনিয়নের দাতিয়াদহ গ্রামে বাড়ি শ্যামল দত্তের । দু’জনের বাড়ির দূরত্ব ২ কিলোমিটার হলের তাদের কখনো বন্ধুত্বেও বন্ধন ছিন্ন হয়নি ।
গোলাম ছরোয়ার বলেন,৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণি আমরা বাবুখালি আফতাফ উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়া পড়াশুনা করি । এ বিদ্যালয় থেকেই আমরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বে সাথে পাশ করি । সেই সময় থেকে শ্যামলের সাথে আমার গভীর বন্ধুদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । স্কুল জীবন থেকে এ বন্ধুত্ব বজায় রাখতে আমাদেও অনেক ঘাত-প্রতি ঘাত সহ্য করতে হয়েছে । দু’জনের পারিবারের মাঝে সুসম্পর্ক রেখেই চলছে আমাদেও বন্ধুত্ব । এ বন্ধুত্বেও বন্ধন বজায় রাখতে আমরা এক সময় দু’জন মসজিদ হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যে,যতদিন বাঁচবো দুজন দুজনের পাশে থাকবো । কোন বাধা বিপত্তি এলো দু’জন এক সাথে মোকাবিলা করবো । তারপর থেকেই আমরা দুজন মিলে বাবুখালি বাজারে “সেবা স্টোর ” নামে একটি ছোট্ট স্টেশনারী মুদি দোকান পরিচালনা করে আসছি । শ্যামলের মধ্যে মেধা,প্রজ্ঞা,সততা,নিষ্ঠা ও অমানবিক সাবলিল ব্যবহার আমাকে বার বার মুগ্ধ করতো । তাই আমার ব্যবসার সব টাকা পয়সা তার নিকট রেখে পরিচালনা করে আসছি । আরো সে তার সততা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা কওে আসছে । ব্যবসা করতে করতে ১৯৯০ সালে এক সময় আমরা দুজন পরিকল্পনা করি বিদেশ যাওয়ার । তারপর সব ঠিক হয়ে গেলেও আমাদের যাওয়া হয়নি । ব্যর্থ হয়ে ৪ লক্ষ টাকা খোয়া যায় এ সময় । পওে আবার দু’জন ব্যবসায় মনোযোগ দেয় । শুরু করি ধান কিনে চালের ব্যবসা । এ ব্যবসায় আমাদেও ক্রমেই লাভজনক হয় । পরে বিভিন্ন কোম্পানির ডিলারের ব্যবসা করি । বর্তমানের এ মুদি দোকানটি আমরা দু’জন অত্যন্ত সাফল্যেও সাথে পরিচালনা করছি । দিনের সব সময়ই প্রায় কেটে যায় দুজনের । দুজনের পারিবারের থেকে দুপুওে খাবার আসে আমরা দুজনেরই তা ভাগ কওে খায় । বয়স তখন ৩০ এর উপওে তখনই দুজনের পরিবারের কাছ থেকে বিয়ে করার প্রচন্ড চাপ আসে । চাপ আসে সমাজের অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে । এ অবস্থায় আমরা দুজনই বিপাকে পড়ি । সিদ্ধান্ত নেই বিয়ে করলে নারীর কারণে হয়তো আমাদেও দীর্ঘদিনের এ বন্ধত্ব হারিয়ে যাবে । তাই এক বন্ধু অন্য বন্ধু থেকে হারানোর ভয়ে আমরা দুুজনের কেউই বিবাহ বন্ধনে রাজী হয়নি । ভবিষ্যতেও আমরা বিয়ে না করার পক্ষে । যতদিন বাচঁবো দ’ুবন্ধু এক সাথে বাঁচবো ।
অন্য বন্ধু শ্যামল দত্ত বলেন,সঠিক মন,সঠিক ভালোবাসা ও গভীর বিশ^াসের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব । আমাদেও দু’জন দুই সম্প্রদায়ের হলেও আমাদেও মন ও বিশ^াস এক । আমরা সব সময় এক অপরকে গভীরভাবে বিশ^াস করি । সেই থেকেই আমাদের মাঝে এ বন্ধুত্বে বন্ধন হয়েছে গভীর । এ বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরো গভীর করতে আমরা দুজনেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । পৃথিবীর কেই আমাদেও এ বন্ধুত্বে মাঝে ফাটল ধরাতে পারবে না । আজ ৫০ বছরের উর্ধ্ব আমাদের বয়স । এ সময়ে আমাদের বিয়ে শেষ করে ছেলে-মেয়ে মানুষ করার কথা কিন্তু এখনো এ বন্ধুত্বে বন্ধন যাতে ছিন্ন না হয় সেজন্য আমরা কেউই বিয়ে করিনি । তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি আমাদেও বন্ধুত্বে কারণ হয়ে দাঁড়ায় এ ভয়ে । আমাদের এ বন্ধুত্বকে দু’পরিবারের সবাই ভালো চোখে দেখে । আমরা মা,ভাই,বোন সবাই গোলাম ছরোয়ারকে ভালোবাসে । আমার মা আমার বন্ধু ছরোয়ারকে ছেলে বলে সম্বোধন কওে ডাকে । আবার ছরোয়ারের মাও আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসে । আমরা দু’বন্ধু আমাদের গ্রামের কেউ গভীর বিপদে পড়লে ছুটে যায় এবং তার পাশে দাঁড়ায় । নিজেদেও সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতার চেষ্টা করি । গ্রামের অসহায়,দরিদ্র ও দুস্থ কেউ সমস্যায় পড়লে তাদেও সাহায়্যেও জন্য আমরা চেষ্টা করি । আমরা দু’বন্ধু সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই সব সময় ।
বাবুখালি এলাকার পল্লী চিকিৎসক নাইম হাসান বাবলু জানান,গোলাম ছরোয়ার ও শ্যামল দা কে আমি চিনি । ছোটবেলা থেকেই দেখছি তাদেও বন্ধুত্বেও ভাব । দীর্ঘ ৩৬ বছর এ দু বন্ধু বিয়ে না করে একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসে । তাদের বন্ধুত্ব দেখে আমি খুবই আর্বিভিত ও মুগ্ধ । আমার জীবনে এ রকম বন্ধু কোনদিন দেখিনি ।
এলাকার ইজিবাইক চালক আল-আমিন বলেন,তারা আমাদের গ্রামের সন্তান । তাদেও বন্ধুত্ব দেখে আমরা গ্রামবাসী খুবই খুশি । তাদের এ বন্ধু দেখে অনেকে বিশ্মিত হয়েছে । দু’বন্ধুর আচারণ,কথাবার্তা খুুবই প্রশংসিত ।আমরা তাদের সার্বিক সাফল্য কামনা করি । যুগ যুগ ধওে অটুট থাকুন এ বন্ধুত্ব ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ইউনুস মৃধা বলেন,বন্ধুর বন্ধুর পাশে এমনভাবে সেবা করছে যেন তা দেখে মুগ্ধ সবাই । দুজনের মনের বিশ^াস একই,দুজনই দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে এ থেকেই তাদেও বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে । আমার ভাবতে অবাক লাগে ,যে বয়সে তাদের সন্তানদেও সাথে সময় দেওয়ার কথা অথচ তারা দুইজনই সবাই থেকে আলাদা । এটা অবশ্যই ব্যতিক্রম একটা বিষয় । বিয়ে না করে ৩৬ বছরের এ বন্ধুত্ব আরো গভীর হোক এ আমার প্রত্যাশা ।