শনিবার ● ১৭ আগস্ট ২০২৪
প্রথম পাতা » পরিবেশ » নালসো পিঁপড়ার ডিমে চলে সংসার; বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে নালসোর বংশবিস্তারে
নালসো পিঁপড়ার ডিমে চলে সংসার; বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে নালসোর বংশবিস্তারে
জীবিকার জন্য কত বিচিত্র কাজই না করে মানুষ। তেমনি এক বিচিত্র পেশা পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করা। এরা বন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে পিঁপড়ার ডিম। তাও আবার লাল পিঁপড়ার ডিম। মাছ শিকারিদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হচ্ছে পিঁপড়ার ডিম। এসব ডিম সংগ্রহের পর তা বিক্রি করে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে এক একজন এক এক রমক পেশা বেছে নেন। জীবিকা নির্বাহ করতে এমন অনেক বিচিত্র পেশা আছে। এমনই এক বিচিত্র পেশায় চলে উপকূল এলাকার ৫০ পরিবারের জীবন জীবিকা। নালসো পিঁপড়ার ডিমে চলে তাদের সংসার।
পাইকগাছাসহ উপকূল অঞ্চলের বিভিন্ন বাগান থেকে নালসোর বাসা ভেঙে ডিম ও বাচ্চা সংগ্রহ করে বিক্রি করে প্রায় ৫০ পরিবারের জীবন জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। এ সকল ব্যক্তিরা সারা বছর এ অঞ্চলের বিভিন্ন বাগান থেকে নালসো পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে বিক্রয়কৃত অর্থে নির্বাহ করছে তাদের সংসার। তবে নালসোর বাসা ভেঙ্গে ডিম সংগ্রহ করায় নালসোর বংশ বিস্তার যেমন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে।
পিঁপড়া বা পিপিলিকা হলো ফার্মিসিডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত সামাজিক কীট বা পোকা। বোলতা বা মৌমাছি পিঁপড়ার ঘনিষ্ট প্রজাতি। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ২২ হাজার প্রজাতির খোঁজ মিলেছে। যার মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারটির শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব স্থানেই পিঁপড়া দেখা যায়। পিঁপড়ারা ১শ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে বাস করে। পিঁপড়ারা সামাজিক পতঙ্গ। তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। মাটির গর্তে, কাঠের ছিদ্রের ভিতরে, ময়লা-আবর্জনা ও গাছে বসবাস করে। গাছে বসবাসকারী লাল পিঁপড়াকে আঞ্চলিকভাবে নালসো পিঁপড়া বলে এ অঞ্চলে ডাকা হয়।
সৌখিন মাছ শিকারী বা মাছ শিকারীদের কাছে নালসোর ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মাছ ধরার টোপ হিসেবে যে কোন উপাদান থেকে নালসোর ডিম খুব উত্তম। নালসোর ডিমের টোপ বা চারে মাছ দ্রুত এসে ধরে। এ কারণে মাছ শিকারীদের কাছে নালসোর ডিমের চাহিদা থাকায় এলাকার বিভিন্ন বাগান থেকে নালসোর ডিম সংগ্রহ চলছে। সংগ্রহকারীরা নালসোর ডিম সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোরে প্রতিকেজি ১ হাজার থেকে ১২ শত টাকা পাইকারী দরে বিক্রি করছে। সংগৃহীত ডিম ঢাকা, বরিশাল সহ বিভিন্ন জেলায় মৎস শিকারীদের কাছে ১৫শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। নালসো পিঁপড়া বাগানে বিভিন্ন গাছের পাতা মোড়াইয়ে বাসা তৈরি করে। গাছের পাতা দিয়ে বাসা তৈরির সময় নালসো তাদের লালা দিয়ে পাতার সঙ্গে পাতা মুড়িয়ে গোল বাসা তৈরি করে। পাতার সঙ্গে পাতা মোড়ানো নালসোর লালা টিসু পেপারের মত দেখা যায়। বাসার ভিতরে বিভিন্ন ধাপে ধাপে লালা দিয়ে বাসার ভিতরে কুটরি তৈরি করে। নালসোর ডিম খুব ছোট থেকে বড় বড় মুড়ির মত তৈরি হওয়ার পর বাচ্চায় পরিণত হয়। ধপধপে সাদা বাচ্চাগুলি হাত পা সহ যেন ঘুমানো অবস্থায় দেখা যায়।
ডিম সংগ্রহকারীরা এক একটি বাসা ভেঙে ৩শ থেকে ৫শ গ্রাম ডিম ও বাচ্চা পায়। ডিম সংগ্রহকারীরা লম্বা বাঁশের মাথায় কাপড় গোল পাত্র তৈরি করে বাসা ভেঙে ডিম সংগ্রহ করে। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন বাগান থেকে বাসা ভেঙে ৪/৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করতে পারে বলে জানা গেছে। ডিম সংগ্রহকারী সাতক্ষীরা জেলার বুধহাটা গ্রামের রহিম সরদার, ধুলিয়ারের করিম মোড়ল, হািফজুর রহমান, চুকনগরের আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুস সামাদ, পাইকগাছা উপজেলার আগড়ঘাটার আবুল হোসেন জানান, তিনি প্রায় ১২ বছর ধরে নালসোর ডিম ভেঙ্গে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। তারা প্রতিদিন পাইকগাছাসহ বিভিন্ন এলাকার বাগান থেকে ডিম সংগ্রহ করে সাতক্ষীরা ও খুলনায় নিয়ে পাইকারী বিক্রি করে আসে। এই ডিম যশোর, বরিশাল ও ঢাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এমন বিচিত্র পেশায় উপকূলের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি লাল পিঁপড়া বা নালসোর পিঁপড়ার ডিম বিক্রি করে জীবন জীবিকায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
শীত শুরু হলে নালসোর ডিম পাওয়া না যাওয়ায় তারা প্রতিদিন বিভিন্ন বাগান থেকে ডিম সংগ্রহ করছে। নালসো পিঁপড়া বাগানের বিভিন্ন গাছে গাছে দেখা যায়। তারা গাছের পাতা মুড়িয়ে বাসা করে বসবাস করে। নালসো কোন উপকারে না আসলেও তেমন কোন ক্ষতি করে না। তবে বিভিন্ন ফলের মুকুল বা কচি পাতা মুড়িয়ে তারা পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এলাকার বিভিন্ন বাগান থেকে নালসো পিঁপড়ার বাসা ভেঙে ডিম ও বাচ্চা সংগ্রহ করায় নালসোর বংশ বিস্তার মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে ও পাশাপাশি জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। এভাবে নালসোর বাসা ভেঙে ডিম ও বাচ্চা সংগ্রহ করলে জীববৈচিত্র থেকে এক সময় নালসো পিঁপড়া হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।