শুক্রবার ● ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শরতের শুভ্রতায় কাশফুল
শরতের শুভ্রতায় কাশফুল
প্রকাশ ঘোষ বিধান
নীল আকাশে চলছে সাদা-কালো মেঘের লুকোচুরি। ধরণীর বুকে উঁকি দিচ্ছে কাশফুল। কাশফুলের শুভ্রতায় আকাশের সাদা ঘন মেঘ যেন পেঁজা তুলোর মতো নেমে আসে ধরণীতে। বর্ষা অনেকের প্রিয় ঋতু হলেও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিক থেকে শরৎ অনন্য। বর্ষার অঝোরধারার পর শরতের সতেজ মাটিতে গাছপালা খুঁজে পায় ঝলমলে রোদ। পথের দূর্বাঘাসে শিশিরের আলপনার ছোয়া। জেগে উঠে গোটা প্রকৃতি। শরতের শান্ত প্রকৃতি গাঢ় নীল আকাশ ও শুভ্র প্রাণের কাশফুল। সবমিলিয়ে শরতের সঙ্গে মেঘ, কাশফুল আর শিউলির সম্পর্ক যেন অচ্ছেদ্য।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। শরতের সঙ্গে স্নিগ্ধতার সম্পর্ক চিরায়ত। ঋতুচক্রে এখন শরৎকাল। স্বপ্ন ও শুভ্রতার প্রতীক হয়ে শরতে আসে কাশফুল। শিশিরভেজা শিউলি, বাতাসে মৃদু দোল খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ। কাশবনে দল বেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। দূর আকাশে মেঘের দল ভেঙে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে নীলের উজ্জ্বলতা। শরতের সেই শুভ্র মেঘের নরম নীল আকাশ আবার এসেছে ফিরে। নদীর চরে ফুটেছে শুভ্র নরম কাশফুল। যে শুভ্রতা ছুঁয়ে গেছে আমাদের মনে ও বাংলার রূপে। নদীতীরে বাতাসে ঢেউখেলা সেই কাশের সারি, কাশফুল ছুঁয়ে দুরন্ত শিশুর মায়াবী হাসি দুই চোখ ভরে দেখেছে মানুষ।
কাশফুল একধরনের বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরনের ঘাস। এরা উচ্চতায় সাধারনত ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। নদীর তীরে ফুলফোটা শ্বেতশুভ্র কাশবন দেখতে খুবই সুন্দর। এর আদিবাস রোমানিয়া। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়।আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির কাশ রয়েছে। সমতলে এক প্রজাতি এবং পাহাড়ে দুই প্রজাতি। তবে সবার কাছে সমতলের প্রজাতিটি প্রিয় এবং সহজে দর্শনযোগ্য। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হল নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। শরত ঋতুতে সাদা ধবধবে কাশফুল ফোঁটে। কাশফুল পালকের মতো নরম এবং রঙ ধবদবে সাদা। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ খুবই ধারালো।
গ্রাম এলাকার জ্বালানি ও কম দামে পানের বরজের ছাউনি হিসেবে কাশের ব্যবহার হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের মতে, কাশফুলের বেশ কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন- পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। এছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হয়।
কাশ বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুলের মধ্যে একটি। একটি ঘাস তার ফুল দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছে। আমাদের শিখিয়েছে কোমলতা ও সরলতা। পৃথিবীতে কোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ফুলের এত কদর এবং মানুষের জয় করে নেওয়ার আছে কিনা জানা নেই। বাংলা সাহিত্যে এ ফুলের উপস্থিতিও ব্যাপক।
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বাংলাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কাশফুল ছিল। কাশফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম কুশ। এরা দেখতে প্রায় কাশফুলের মতোই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পুরাণ-এ কুশের স্থান খুব উঁচুতে। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে। শুভ্রতা অর্থে ভয় দূর করে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়।
কাশফুল পালকের মতো নরম। শরতে আমাদের মন ছুটে যায় সবুজ ঘাসের ওপর নুয়ে পড়া কাশবনে। শরতের উদ্ভিদরাজ্যে নীলের নীলিমা কম, শুভ্রতাই বেশি। তবে সে অভাব ঘুচিয়ে দেয় নীলাকাশ। ভাদ্র-আশ্বিনের প্রকৃতিতে শরতের আকাশজুড়ে নরম সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায় পালতোলা নৌকার মতো। হেমন্তের কার্তিকেও শরতের রেশটুকু যেন শেষ হতে চায় না।
বর্ষার বৃষ্টিমুখর অনুজ্জ্বল দিনের পর শরতের মেঘের মতো আমাদের মনও যেন হালকা হয়ে যায়। প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় শরতের আগমনী বার্তা। শরতের আকাশ, নদী, ফুল সবই শান্ত, মায়াময়। ভাদ্র-আশ্বিনের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট