মঙ্গলবার ● ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনা
প্রকাশ ঘোষ বিধান
সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ দেশে দেশে ভ্রমণ করে আসছে। পৃথিবী দেখার দুর্নিবার নেশায় মানুষ বিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে অজানা দেশে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করে থাকে মানুষ। এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। অন্যদিকে মানুষের একে অপরকে জানার আগ্রহ থেকে ঘটেছে পর্যটন শিল্পের বিকাশ। মানুষের এই দুর্নিবার ভ্রমণাকাঙ্ক্ষা থেকেই পর্যটনশিল্পের উৎপত্তি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে পর্যটনের রূপ ও প্রকৃতিতে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন। পর্যটন এখন শুধু কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দেশভ্রমণ নয়, বরং সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশ্বজনীন শখ ও নেশা। আর তাই পর্যটন এখন একটি শিল্প, যা অনেক দেশের অর্থনীতির একটি মুখ্য উপাদান। ইতিমধ্যেই এ শিল্প বিশ্বব্যাপী একটি দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্বের পর্যটনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষ অজানাকে জানতে চায়, অবলোকন করতে চায় সুন্দরকে, আবিষ্কার করতে চাই নতুনকে। অনুসন্ধিৎ্সু মনের সহজাত তাড়নায় সে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। চতুর্দশ দশকের ফখরুদ্দিন শাহর শাসনামলে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সুদূর আফ্রিকার মরক্কো থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর আমলে চীন থেকে হিউয়েন সাং তখনকার বাংলাদেশের রাজধানী সোনারগাঁও পরিভ্রমণে এসেছিলেন। ভাস্কো-দা-গামা এশিয়ায় পর্যটন করেছিলেন। ফলে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল মৈত্রীবন্ধন। কলম্বাসের পর্যটনে নতুন মহাদেশ আমেরিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল। আজও বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন স্থাপনে অনন্য ভূমিকা পালন করে পর্যটন।
পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনা- সমৃদ্ধ দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশ নানা সময়ে নানান রূপের দেখা মিলে। ঋতুতে ঋতুতে রঙ আর রুপের অপরুপ বর্ণিল শোভা সবকিছু মিলে এদেশ সৌন্দর্য মহিমায় অনন্য। দিগন্তজুড়ে সবুজের পটভূমি, বাংলার ভূখণ্ডের বুক চিড়ে ছুটে চলা অসংখ ছোটবড় নদী, পূর্ব পাহাড়ের সৌন্দর্য, দক্ষিণের ম্যানগ্রোভ বন ও সমুদ্র সৈকত, দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলার ইতিহাসের প্রসিদ্ধ স্থাপনা ও হাজার বছরের ইতিহাসের বাহক পুরাকৃর্তি দেশি বিদেশী পর্যটকদের বিষ্মিত ও বিহোমিত করে। নদীবিধৌত ও পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ,অপরূপ শিল্পের সেরা প্রদর্শনী বাংলাদেশ। পর্যটক শিল্পের অন্যতম উপাদানগুলি হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপনা, ধর্মীয় স্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পৌরাণিক ইত্যাদি যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। অপরিমেয় সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে এই দেশে। বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যটন শিল্পের বিকাশে একটি অনন্য উপাদান। এই অনন্য প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগ করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা বাংলাদেশে এসেছেন যুগ যুগ ধরে। বাংলাদেশে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এমন দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক স্থান বাংলাদেশে প্রচুর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কুয়াকাটা সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সুন্দর সমুদ্র সৈকত, কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকার চা বাগান, তামাবিল, জাফলং, রাঙ্গামাটির অত্যাশ্চর্য কৃত্রিম হ্রদ, সুন্দরবন উপকূলীয় দ্বীপ। অ্যাডভেঞ্চার এবং ইকো-ট্যুরিজমের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন সাগরের বুকে সুন্দর দ্বীপ, রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বোটিং, ফিশিং, ওয়াটার স্পোর্টস, ট্রেকিং, হাইকিং ইত্যাদির সুযোগ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় জাদুঘর, সেনারগাঁও জাদুঘর, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, নাটোরের রাজবাড়ী ও পুঠিয়াসহ আরও অনেক সাংস্কৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা মূলত ধর্মীয় অনুভূতির কারণে নির্দিষ্ট স্থানে ভ্রমণ করে। বাংলাদেশে ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণ অসংখ্য। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মাজার, দরগা এবং অন্যান্য স্মৃতিস্তম্ভ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এসব আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের ছয় গম্বুজ মসজিদ, ঢাকার সাত গম্বুজ মসজিদ, রাজশাহীতে শাহ মখদুমের মাজার, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়, নবাবগঞ্জের সেনা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, আর্মেনিয়ান গির্জা, বায়েজিদ বেস্তামীর দরগা, ছিন্নমূলের দরগাহ। সিলেটের শাহজালার দরগাহ, কক্সবাজারের রামু মন্দির, রাজশাহীর তাহেরপুর রাজবাড়ী উল্লেখযোগ্য ।
পর্যটন শিল্প বিশ্বের এক অন্যতম বৃহৎ শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পর্যটনশিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। থাইল্যান্ড, নেপাল, কাশ্মীর, ইন্দোনেশিয়া, তিউনিশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র পথ হলো পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনা- সমৃদ্ধ দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্প নানাভাবে অবদান রাখতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাছাড়া পর্যটন শিল্পের কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও বেকারত্ব দুর হচ্ছে। কুটির শিল্প ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। পর্যটন শিল্পখাতে আমাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের পর্যটন শিল্পের আয় ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আছে। আমাদের বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়াই। পর্যটন শিল্পে অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয়। পর্যটকরা স্বল্প সময় ও কম খরচে নিরাপদ ভ্রমণ চান। এখনো পর্যটন স্পটসমূহে উন্নত হোটেল ও উন্নত খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। বিদেশি পর্যটকদের সংস্কৃতিকে এ দেশে অনেকেই সহজভাবে নিতে পারে না। তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার, নেতিবাচক মনোভাব অনেকেই পোষণ করে থাকে। পর্যটকরা বাংলাদেশে প্রায়ই হয়রানি ও ছিনতাইয়ের শিকার হন। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা।
সারা পৃথিবীব্যাপী পর্যটন শিল্প এখন একটি সেরা উদীয়মান খাত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পর্যটকদের ভ্রমণ-সংক্রান্ত ব্যয় স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থের লেনদেন বাড়িয়ে দে ফলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পায়। পর্যটন শিল্প ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। পর্যটন খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রচার প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পর্যটকদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। এতে করে আমাদের বাঙ্গালি জাতির প্রাচীন ইতিহাস বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পর্যটন শিল্প আমাদের বেকারত্ব দূরীকরণসহ, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পর্যটন শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে একটি বিরাট উৎস হতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট