শুক্রবার ● ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে দরকার গণসচেতনতা
প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে দরকার গণসচেতনতা
প্রকাশ ঘোষ বিধান
মানুষ প্রবীণ হয়ে জন্মায় না। মানুষের জীবনে বার্ধক্য একটা স্বাভাবিক পরিণতি। মানুষের জীবনচক্র নবজাতক, শৈশব, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক ও বার্ধক্য। জীবনের শেষ ধাপ বার্ধক্যকালে অবস্থানরত মানুষকে আমরা প্রবীণ বলি। আমাদের দেশে ৬০ বছর বয়সী মানুষদের প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। প্রবীণ আর বার্ধক্যকাল এক নয়। প্রবীণ ব্যক্তি বার্ধক্যে পতিত নাও হতে পারে। প্রবীণ মানে মাথায় এক ঝাঁক সাদা চুলের অধিকারী ব্যক্তি হলেও তাঁরা অভিজ্ঞতায় ভরপুর। প্রবীণ শব্দের মূল অর্থ হল সমাজের বুদ্ধিসম্পন্ন, বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তি।
মানব জীবনে বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা। মানুষের জীবনে বার্ধক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আজকে যারা যুবক তারা আগামী দিনে প্রবীণ। মানব জীবনচক্র মূলত কয়েকটি স্তরের সমষ্টি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য এই পাঁচটি স্তরে মানুষের জীবনকে ভাগ করা হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই জীবনের এক একটা স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরে উপনীত হতে হয়। জীবন চক্রের সর্বশেষ ধাপ বা পরিণতি হলো বার্ধক্য।
১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯১ সাল থেকেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রবীণ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শিশু আর বার্ধক্য এই দুই পর্যায়েই মানুষের অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি শিশুই পরম মাতৃস্নেহে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলেও বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন থেকে বঞ্চিত হন। অথচ সমাজের সবচাইতে অভিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ এই প্রবীণ জনগোষ্ঠীরই অংশ। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ প্রবীণ। দেশের আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক উভয় পরিমন্ডলেই প্রবীণ জনগোষ্ঠী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শৈশবে জীবন শুরু আর বার্ধক্যে শেষ। আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের বৃদ্ধ বা প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। প্রবীণদের বিভিন্ন সরকারি ও সামাজিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে এ বয়সসীমা বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত তিনটি কারণে মানুষ তুলনামূলকভাবে দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছায়। দরিদ্রতা, শারীরিক শ্রম ও অসুস্থতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান। জাতিসংঘ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সী উপরে জনগোষ্ঠীকে প্রবীণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এছাড়া, এ প্রতিষ্ঠানের মতে প্রবীণকে আরও ৩টি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন-প্রাচীনতম প্রবীণ ৮০ বছর বয়সীর উপরে, শতবর্ষীয় প্রবীণ ১০০ বছর বয়সীর উপরে ও সুপার শতবর্ষীয় প্রবীণ ১১০বছর বয়সীর উপরে।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭.৪৭।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ প্রবীণ রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দুইকোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি হবে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় পৃথিবীর সব দেশেই প্রবীণের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে এবং তাদের অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাবে। শিল্পোন্নত দেশে ৬৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিগণ প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত হবেন মর্মে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাধারণত ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিবর্গকে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করে।
প্রবীণ ব্যক্তিরা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ। সর্বশেষ জনসংখ্যা ও গৃহায়ণ শুমারি ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বা প্রায় দেড় কোটি মানুষের বয়স ষাট বা তাঁর চেয়ে বেশি। দেড় কোটি প্রবীণের মধ্যে ২০ শতাংশ, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এ বিপুলসংখ্যক দুস্থ প্রবীণের ১০ শতাংশও যদি আশ্রয়হীন হয়ে থাকে, তাহলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ।
প্রবীণদের জীবনকাল বিসর্জনের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই আধুনিক উন্নতমানের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। আধুনিক ও নবীন সমাজ সকলে দায়বদ্ধ প্রবীণ সমাজের নিকট। প্রবীণরাই আমাদের শিশুকাল, শৈশবকাল ও কৈশোরকালের লালন-পালনকারী। প্রবীণদের প্রতি কোন বৈষম্য নয়, কোন করুণা নয় কোন অবহেলা নয় বরং প্রদর্শন করতে হবে নৈতিক ও আদর্শিক প্রতিদান। তারাই আমাদের জীবনের শত প্রেরণার নিরন্তন উৎস। শুধু বয়সের কারণে প্রবীণরা গুরুত্বহীন অবস্থায় অবমূল্যায়নের জীবন ধারণ করবেন, তা সচেতন ও সভ্যসমাজে হতে পারে না।
প্রবীণেরা পরিবার ও সমাজে অবহেলিত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হন। মা-বাবা শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর সন্তানকে কখনো ভাগ করেন না। তেমনি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে ভাগ করা যাবে না। একজন সক্ষম মানুষ তার জীবনের পুরোটা সময় শেষ করে দেয় যে পরিবারের জন্য, জীবনের শেষ সময়ে সেই পরিবারে থাকাটা তার নৈতিক অধিকার। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ কাজে লাগিয়ে নবীনদের এগিয়ে যেতে হবে। সুস্থ সবল প্রবীণের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে লাগানো যেতে পারে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও কর্মক্ষমতার সঙ্গে প্রবীণদের মেধা-মনন-অভিজ্ঞতা সংযোগ করা যায়, তাতে দেশের উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে পরিবার ও সমাজে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট