বুধবার ● ১৬ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শতবর্ষ পরেও স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল আবদুল্লাহ উপন্যাস
শতবর্ষ পরেও স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল আবদুল্লাহ উপন্যাস
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যন্ত্রণাজর্জর এই যুগ-প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন মুক্তচিত্ত-দ্রোহী এক আধুনিক শিল্পী কাজী ইমদাদুল হক। তার লেখা আবদুল্লাহ্ উপন্যাস বাঙালি মুসলমানের সমাজচিত্র হিসেবে মূল্যবান। এই উপন্যাসে তত্কালীন মুসলিম সমাজের নানা দোষত্রুটি তিনি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেন। ক্ষয়িষ্ণু যা অসংগত, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাকে লেখক প্রবলভাবে আক্রমণ করেছেন। আবদুল্লাহ উপন্যাসে মুসলিম সমাজের পীরপ্রথার অন্ধ অনুকরণ, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাত-পাতের বড়াই ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
মুসলিম সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস আশরাফ-আতরাফ, পীরের ওপর অন্ধভক্তি, অযৌক্তিক গোঁড়ামি, বংশীয় গৌরবের প্রবল দাম্ভিকতা, মিথ্যা আচারসর্বস্বতা, পারিবারিক শাসনের কঠোরতা, বহুবিবাহকে ধর্মীয় সমর্থন দেওয়া, সুদ এসব বিষয়গুলোর প্রতি লেখকের প্রতিবাদ সুস্পষ্ট। গত শতাব্দীতে এই সমস্যাগুলো প্রকট ছিল। তবে বর্তমান সময়ে যে নেই তা বলা যাবেনা। এখনো আমাদের দেশে নানারকম কুসংস্কারে মানুষের মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এসব কুসংস্কার থেকে বের হতে পারিনি। তাই শতবর্ষ পরেও অন্যতম গৌরবময় কীর্তি আবদুল্লাহ উপন্যাস।সমাজচিত্র ও শিক্ষামূলক উপাদান লেখাগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক আলোকিত মাত্রা। স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল সম্প্রদায়বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মানবতাবাদী সমাজচিত্র।
কাজী ইমদাদুল হক ১৮৮২ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী আতাউল হক আসামের জরিপ বিভাগে চাকরি করতে করতেন এবং পরবর্তীতে খুলনার ফৌজদারি আদালতের মোক্তার নিযুক্ত হন।
বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যেসব বাঙালি মুসলমান মননশীল গদ্য লেখক বিশিষ্টতা অর্জন করেন, কাজী ইমদাদুল হক তার মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর তৎকালীন মুসলমান সমাজে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভার অধিকারী হয়ে সাহিত্য অঙ্গন আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। বাঙালি মুসলমান সমাজের কল্যাণসাধন ছিল ইমদাদুল হকের সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য।
১৯০০ সালে কাজী ইমদাদুল হক কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ সম্পন্ন করেন। ১৯০৪ সালে কাজী ইমদাদুল হক কলকাতা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এর দুই বছর পর ১৯০৬ সালে আসামের শিলং বিভাগে শিক্ষাবিভাগের উচ্চমান সহকারী হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৭ সালে তিনি ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক হন। ১৯১১ সালে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভূগোলের অধ্যাপক হন। এরপর ১৯১৪ সালে ঢাকা বিভাগে মুসলিম শিক্ষা সহকারী স্কুল পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৭ সালে তাকে কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২১ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের সুপারিন্টেনডেন্ট হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।শিক্ষাবিভাগে তার যোগ্যতাপূর্ণ কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে তাকে খান সাহেব ও ১৯২৬ সালে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে। কাজী ইমদাদুল হক ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুল্লাহ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে গ্রামীণ মুসলিমসমাজের পীরভক্তি, ধর্মীয় কুসংস্কার, পর্দাপ্রথা, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য, হীন স্বার্থপরতা, সম্প্রদায়বিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে বুর্জোয়া মানবতাবাদী প্রতিবাদ। মধ্যবিত্তের বিকাশের ফলে মুসলিমসমাজের ভিত কিভাবে নড়ে উঠেছে তার চিত্র আছে, আছে সমাজের বহুমাত্রিক জটিলতা ও বিরোধ। তবু স্রষ্টার ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতাবাদী দর্শনই আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের মৌল-অভিজ্ঞান। ইমদাদুল হক স্বপ্ন দেখেছেন মানব-মৈত্রীর, ঘৃণা করেছেন সম্প্রদায়-বিদ্বেষী মানসিকতাকে মুসলিম জীবনচিত্রণ-সূত্রে এ-কথাই উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসে।
এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় আবদুল্লাহ্ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত ; আবদুল্লাহ্ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছি–বিশেষ কারণে, এই বই থেকে মুসলমানের ঘরের কথা জানা গেল। এদেশের সামাজিক আবহাওয়া-ঘটিত একটা কথা এই বই আমাকে ভাবিয়েছে। দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে, সেই অন্ধতাই চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। এ কি মাটির গুণ? এই রোগবিষে ভরা বর্বরতার হাওয়া এদেশে আর কতদিন চলবে? আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব? লেখকের লেখনীর উদারতা বইখানিকে বিশেষ মূল্য দিয়েছে।
আবদুল্লাহ পীরপ্রথা আর কুসংস্কারপ্রিয়তাকে প্রায়শই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে যেমন জর্জরিত করেছে, তেমনি উচ্চারণ করেছে অসাম্প্রদায়িক মানস-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন দেখেছে একটি নতুন সমাজের। এ উপন্যাসটিতে লেখকের সমাজ সচেতনতার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মুসলিম সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস আশরাফ/আতরাফ, পীরের ওপর অন্ধভক্তি, অযৌক্তিক গোঁড়ামি, বংশীয় গৌরবের প্রবল দাম্ভিকতা, মিথ্যা আচারসর্বস্বতা, পারিবারিক শাসনের কঠোরতা, বহুবিবাহকে ধর্মীয় সমর্থন দেওয়া, সুদ ও মুসলিমরা হিন্দুদের থেকে অবহেলিত ইত্যাদি বিষয়গুলোর সমস্যার প্রতি লেখকের রম্য রসিকতা সুস্পষ্ট। এইসব বিকৃত সামাজিক গোঁড়ামি মুসলিম সাধারণ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক জীবনের অন্তরায় ছিল। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে কাজী ইমদাদুল হকের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্থ পরিচ্ছন্ন এবং প্রগতিশীল। তার মার্জিত রুচিবোধে কাহিনী পরিবেশনে একটি উন্নত সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় আছে। লেখক কোনোভাবেই সামাজিক এসব ব্যাধিকে সমর্থন করেনি। আবদুল্লাহ উপন্যাসের মাধ্যমে প্রচলিত পীরপ্রথায় পীরগন, যারা ইসলামি রোকন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মুখোশ পরে সরল বিশ্বাসী জনসাধারণের কাছে প্রভাবশালী মুসলিম ও জনদরদি প্রতাপ সেজেছে, তাদের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্লেদ অশেষ দক্ষতায় অনাবৃত হয়েছে, অথচ সামাজিক বর্বরতা ও বীভৎসতা লেখককে সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত করতে পারেননি। যার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ উপন্যাসটিতে।
৪৪ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে ইমদাদুল হকের প্রধান কীর্তি আবদুল্লাহ্ (১৯৩৩) উপন্যাস। একটিমাত্র উপন্যাস লিখে ইমদাদুল হক বাংলা সাহিত্যে রেখে গেছেন তার স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর। আবদুল্লাহ উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের সময়সীমায় প্রবাহিত মুসলিম জীবনবিশ্বাস এবং জীবন-যন্ত্রণার শিল্পিত ভাষ্য। একটি বিশেষ যুগসত্যকে ধারণ করে রচিত হলেও আবদুল্লাহ সেকালের সীমা পেরিয়ে অভিষিক্ত হয়েছে কালোত্তীর্ণ শিল্পের মর্যাদায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিমজীবন কেমন ছিল, তার অস্তিত্ব মিলবে ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহর পাতায়। আবদুল্লাহ যতটা না শিল্প, তার চেয়ে বড় কথা এ-হচ্ছে সমাজচিত্র, খালি চোখে দেখা সমাজবাস্তবতা।
আবদুল্লাহ উপন্যাস মোট ৪১ পরিচ্ছেদের সমষ্টি হলেও, কাজী ইমদাদুল হক লিখেছেন এর প্রথম ৩০ পরিচ্ছেদ মাত্র; বাকি ১১টি পরিচ্ছেদ লিখে উপন্যাসটির একটা সন্তোষজনক সমাপ্তি টেনেছেন কাজী আনোয়ারুল কাদীর। মোসলেম ভারত (১৯২০) পত্রিকা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ইমদাদুল হকের অসুস্থতাজনিত কারণে কাজী আনোয়ারুল কাদীর মূলত ইমদাদুল হকের খসড়া অবলম্বন করেই উপন্যাসটি সমাপ্ত করেছেন।
আবদুল্লাহ উপন্যাসটি লেখকের জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ বা প্রকাশ হয়নি। তিনি এ উপন্যাসটি জীবনের শেষান্তে শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তার খসড়ার ভিত্তিতে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করা হয় এবং তা ১৯৩৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বর্তমান বাংলা একাডেমি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় প্রকাশ করে কাজী ইমদাদুল হকের রচনাবলি।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্টি