শনিবার ● ২৬ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মানুষের জীবনে বৃক্ষের অবদান
মানুষের জীবনে বৃক্ষের অবদান
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বৃক্ষ মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। বৃক্ষ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বৃক্ষহীন পৃথিবীতে প্রাণের অস্থিত্ব কল্পনাও করা যায় না। গাছ ছাড়া পৃথিবীতে বসবাস করা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বনাঞ্চলের, সেই সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের বিকল্প নেই। মানুষের ত্যাগ করা কার্বন-ডাই-অক্সসাইড বাতাস থেকে গাছ গ্রহণ করে পরিবেশ শিতল রাখছে। আর গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। মানুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। বৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই গাছ মানুষের পরম বন্ধু। মানুষের উপকারে গাছের থেকে এমন বন্ধু আর হয় না। বৃক্ষ শুধু মানষের বন্ধু নয়। গাছ হচ্ছে প্রকৃতি পরিবেশ এবং মানুষের পরম বন্ধু।
বৃক্ষকে বলা হয় অক্সিজেনের কারখানা। একটি গাছ বছরে ১৩ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে নির্মল করে। আর সোয়া ৬ কেজি বিশুদ্ধ অক্সিজেন বাতাসে ছাড়ে। যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশকে দূষিত করছে। বৃক্ষ সে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা করছে। ক্রমাবনতিশীল পরিবেশ ভারসাম্য, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিহত করে পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতে বৃক্ষের কোন বিকল্প নেই।
গাছ নিয়ে- ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বলেছেন, যে জাতি তার মাটি ধ্বংস করে সে নিজেকে ধ্বংস করে। বন হলো আমাদের জমির ফুসফুস, বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং আমাদেরকে নতুন শক্তি দেয়। অক্সিজেন তৈরি ও বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড দূরীকরণ এবং ভূমি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই বৃক্ষ। গাছের উপকারিতা বা গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। গাছের অবদান অপরিসীম। ফল, ফুল, কাঠ, অক্সিজেন, ছায়া- এ সবকিছুই আমরা গাছ থেকে পাই। গাছপালা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য। গাছপালা ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। এই পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরিয়ে দিয়েছে প্রাণদায়ী বৃক্ষরাজি। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে, এর অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
অরণ্য দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের কুঠারের আঘাতে। মানুষের এতো উপকারে আসে তারপরও বৃক্ষ নিধন চলছেই। প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে সুশীতল ছায়া নিয়ে বৃক্ষ যখন প্রাণ জুড়িয়ে দেয়, তখন বোঝা যায় তারও প্রাণ আছে। নানা অজুহাতে মানুষ বৃক্ষ নিধন করে চলেছে।এটি মানুষের আত্মঘাতী কর্ম। দ্রুত শহরায়ন, শিল্পায়ন, আসবাবপত্র তৈরী, শিল্পের কাঁচা মাল তৈরী, জ্বালানী কাঁঠের সরবরাহ ইত্যাদি অজুহাতে বনাভূমি উজাড় হচ্ছে। গাছ কমে যাওয়ায় প্রকৃতির ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ছে। কার্বন-ডাই-অক্সসাইড, কার্বন-মনো-অক্সসাইড, লিথেন সহ প্রভৃতি ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমন্ডল দূষিত হচ্ছে। এক জরিপে জানা গেছে, জ্বালানী থেকে শুরু ঢাকা শহরে সাত টন সিসা ছড়াচ্ছে। বিশ্বের বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় ওজন স্তরে ক্ষয় হয়ে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। এ সব ছিদ্র পথে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি বায়ুমন্ডল ও প্রকৃতির উপর ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে জীব জগত বিরাট হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ ছিদ্র মেরামোত না হলে জীব জগতের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তবে একমাত্র বৃক্ষই পারে এ ছিদ্র মেরামোত করতে। কারণ বায়ুমন্ডল থেকে ক্ষতিকর গ্যাসগুলো গাছ শোষন করে নেয় এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে বায়ুমন্ডল শিতল রাখে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপন করে বনাঞ্চল তৈরী ও সংরক্ষণ জরুরী।
গাছ নানাভাবে মানুষের উপকার করে। ফল, ফুল, কাঠ, অক্সিজেন, ছায়া- এ সবকিছুই আমরা গাছ থেকে পাই। গাছের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট ইন্সটিটিউটের গবেষকরা ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটি গাছের আর্থিক সুবিধা বের করেছেন। যা হল, গাছ বায়ুদূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে ১০ লাখ টাকার, জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয় ৫ লাখ টাকার, বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, বৃক্ষে বসবাসকারী প্রাণীদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ ও ফল সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকার, বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরও ৪০ হাজার টাকা। ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটি বৃক্ষের আর্থিক সুবিধার মোট মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। যেসব এলাকায় গাছ বেশি, সেখানে বন্যা, ঝড় তেমন ক্ষতি করতে পারে না। গাছপালা মায়ের আঁচলের মতো মানুষকে আগলে রেখে রক্ষা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে।
ফলদ বৃক্ষ পরিবেশে রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঔষধ তৈরীর জন্য ভেষজ গাছ খুবই প্রয়োজন এবং এসব ভেষজ গাছ খুবই মূল্যবান। বনজ ও ফলদ বৃক্ষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরণের ভেষজ গাছ লাগিয়ে অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু প্রয়োজন ও প্রাপ্তি ব্যবধানে আমরা খেতে পারছি মাত্র ৪০-৪৫ গ্রাম। ফলে শুধু ভিটামিনের অভাবে দেশের মানুষ অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে ফলে। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় এই ফল গাছ থেকে পাচ্ছি।
বর্তমান বাংলাদেশে ৭০ প্রকারের দেশী ফল জন্মে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশের প্রধান ফল গুলো যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁয়ারা, পেপে, তরমুজ চাষের আওতায় ১ লাখ ২১ হেক্টর জমি ছিল। এর থেকে ফলের মোট উৎপাদন হয় ২৯ লাখ ৫১ হাজার ৭শ মেট্রিক টন। এসব ফলের শতকারা ৬০.৯০ ভাগ উৎপন্ন হয় ৪-৫ মাসে। আর বাকী ৩৯.১০ ভাগ ফল অন্য ৭-৮ মাসে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ মেট্রিক টন তাজা ফল মুল, সাক-সবজী ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ণ এশিয়ার দেশ গুলোতে রপ্তানি হয়ে থাকে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন শাকসবজি ও ফলমূল বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় মোট বনভূমির পরিমাণ খুবই কম। প্রয়োজনী বৃক্ষ রোপন ও সংরক্ষণ করাও হচ্ছে না। বৃক্ষ রোপন করা হলেও বাচিয়ে রাখার জন্য তদারকি দরকার। জনবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি দূর্যোগ মোকাবেলায় বৃক্ষরোপনকে সামাজিক আন্দোলনে পরিনত করতে হবে। বৃক্ষ সম্পদ বৃদ্ধি, সুস্থ্য ও নির্মল পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে দেশের জাতীয় ভাবে বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষনের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সুস্থ্য ও সুন্দর পরিবেশ পেতে দেশের প্রতিটি নাগরিককে বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষনের দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট