শুক্রবার ● ১ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সাংবাদিক ও প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান
সাংবাদিক ও প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান
সাংবাদিক ও প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সিনিয়র নায়েবে আমীর সাবেক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) শামসুর রহমান। তিনি বিগত ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর তার ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী।
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান ১৯১৫ সালের ৫ মে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের মঠবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত কফিল উদ্দিন সরদার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক ও মাতা মৃত শরিফাতুন্নেসা গৃহিনী। তিনি চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। বড়পুত্র খুরশিদুল ইসলাম ও মেঝপুত্র মশিউল আযম উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্যবসা করছেন। সেজ পুত্র ডাক্তার শরিফুল ইসলাম আমেরিকা প্রবাসী এবং ছোট পুত্র মেজর মেসবাহুল ইসলাম। তিন কন্যার মধ্যে মাহমুদা শিরিন ও হুমায়রা পারভীন দেশে এবং বড় কন্যা ফিরোজা বেগম লন্ডনে বসবাস করেন। পরিবারের সকলেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত রয়েছেন।
তার শিক্ষা জীবনটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে সুদুর খুলনা মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম মঠবাটি থেকে কপোতাক্ষের বুক চিরে নৌকা যোগে কলকাতা শহরে যেতেন। প্রায় ৬ মাস পর আবার নৌকা যোগে বাড়ি আসতেন। এভাবে তিনি কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৩৪ সালে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করে ১৯৩৭ সালে বাগেরহাটের সরকারি পিসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করে ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ঐ সময়ে হাতে গোনা যে স্নাতক ডিগ্রিধারী লোক পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে ছিল, তার মধ্যে তিনি অন্যতম। শামসুর রহমান ১৯৩৯ সালে মেদিনীপুর জেলার কৃষ্ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪১ সালে তিনি কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান।
খুলনার ১৪২ স্যার ইকবাল রোডে মুসলিম আর্ট প্রেস নামক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। এছাড়া তিনি তাওহীদ স্টেশনারী মার্ট নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় কাজ শুরু করেন। ৫০-এর দশকে তিনি নগরীর আলতাপোল লেন থেকে তাওহীদ পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরপর তিনি সাপ্তাহিক তাওহীদ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। ১৯৫২ সালে তাওহীদ পত্রিকাটিকে জামায়াতের মুখপাত্র হিসেবে কাজে লাগান। ঐ সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায় তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ মাঠে নামে। গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে যে, ঐ পত্রিকাটির সাথে শামসুর রহমান সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। তখন প্রশাসন তাকে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করে। তারপরও বেশ কিছুদিন পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন। ২০০৩ সালে খুলনা প্রেস ক্লাবে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি তার জীবনের এমন একটি ঘটনা প্রকাশ করে বলেন, সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা যুগে যুগে ছিল, এখনও আছে এবং থাকবে; তারপরেও কলমযোদ্ধারা সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে। সরকারি নিপীড়ন থেকে তিনি রক্ষা পাননি। তার ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রেসটিও তৎকালীন সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগ দেন। একজন সুলেখক হিসেবে তিনি যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেন। অবজারভার এবং এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি)র সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর ১৯৫৯ সালে তার নেতৃত্বে খুলনা প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন শহরের মির্জাপুরস্থ জহুরুল হক সরদারের (মৃত্যু ১১ আগষ্ট ১৯৯০) বাড়ীতে শামসুর রহমানকে সভাপতি ও জহুরুল হক সরদারকে সেক্রেটারি করে খুলনা প্রেসক্লাবের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটিতে ছিলেন এমন দুইজনের নাম জানা গেছে, তারা হলেন এম এস ওয়ার্সী ও সৈয়দ সা’দ আলী। ক্লাবের সূচনালগ্নে শামসুর রহমান দৈনিক ইত্তেহাদ, জহুরুল হক সরদার সংবাদ সংস্থা ইউপিপি, সৈয়দ সা’দ আলী আজাদ, এম এস ওয়ার্সী মর্নিং নিউজের খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাবিবুর রহমান ৫৯ সালে খুলনা সফরে আসেন। তার সফরসূচিতে প্রেসক্লাব পরিদর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু খুলনাতে তখন কোন প্রেসক্লাব না থাকায় সাংবাদিকরা জহুরুল হকের বাড়িতে এক সভায় মিলিত হন এবং প্রেসক্লাব গঠন করেন। যে কারণে বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা মনে করেন খুলনার সাংবাদিকতা ও প্রেসক্লাবের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে শামসুর রহমানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি একটি রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্বাসী হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে। সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে ফুল টাইম রাজনীতিবিদ হয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাংবাদিকদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। যে কারণে খুলনার সাংবাদিক সমাজ তাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সাংবাদিকতা শেষ করতে না করতেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি জামায়াতের রুকন হন এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর খুলনা জেলা শাখার আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ৪ বছর খুলনা বিভাগের সেক্রেটারি ও ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ২০ বছর জামায়াতের নায়েবে আমীর হিসেবে এবং দারুল ইসলাম ট্রাষ্টের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জামায়াতের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য যে কমিটি হয়েছিল তার আহবায়ক ছিলেন। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মত তাকে ৭ মাস জেল খাটতে হয়। সর্বশেষ তিনি ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) আসনে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
তিনি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুসলিম এইড ইউ.কে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, দারুল ইসলাম ট্রাষ্ট, আধুনিক প্রকাশনী ও সিরাতুল হুদা ট্রাষ্ট এর চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি দৈনিক সংগ্রামে ফালাহ-ই-আম ট্রাষ্ট বিল্ডিং এ দীর্ঘদিন অবস্থান করেছেন এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭৯ থেকে ৮১ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। পরবর্তীতে নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৯৩ বছর জীবনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি কর্মমুখর ছিলেন।