বুধবার ● ২৭ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য অপরিহার্য
পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য অপরিহার্য
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের ঋতু শীতকাল। শীত কালকে আরও অপরূপ করে তুলে পরিযায়ী পাখির আগমন। প্রতি বছর শীতে দূর-দূরান্ত থেকে শীতের পাখিরা আসে আমাদের দেশে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ পাখি দেখতে ভিড় করে বিভিন্ন জলাশয়ে। পাখিদের কলকাকলী প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণে। শীত আসলেই আমাদের দেশের জলাশয়, হাওড়, বিল ও পুকুর রং-বেরঙের পাখিতে ভরে যায়। এসব পাখি আমাদের দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয়, বরং শীতপ্রধান দেশ থেকে শীত থেকে বাঁচতে এখানে আসে। এদেরকে অতিথি পাখি বলা হলেও মূলত এরা পরিযায়ী পাখি।
আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে আমাদের দেশে পাখি প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এরই মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০টি প্রজাতি থেকে যায়।
শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশের হাওর, বিল, জলাশয়ে এরা আশ্রয় নেয়। এই পাখিরা আমাদের দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের পথকে উড়ালপথ বলে। প্রায় সবক’টি উৎস থেকে আসা পাখিরা এ পথের ওপর দিয়ে গিয়ে আফ্রিকায় ছড়িয়ে যায় এবং ফিরতি পথে এ পথ দিয়েই তাদের আগের স্থলে ফিরে যায়। বংশপরম্পরায় এরা কাজটি করে আসছে এবং প্রতি বছর হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করলেও একই স্থানে তারা ফিরে আসে। সিনাই হয়ে আসা-যাওয়ার পথটি ছাড়াও ইউরোপের সিসিলি ও স্পেন হয়ে দুটি, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে দুটি এবং পূর্ব এশিয়ার প্রান্ত ধরে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ আছে। এছাড়াও পৃথিবীতে পরিযায়ী পাখিদের গমনাগমনের ভিন্ন পথ আছে।
আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য বাংলাদেশের সীমানায় স্বীকৃত ২৮টি জায়গা রয়েছে। এগুলো হলো বরিশাল বিভাগের চর বারি, চর বাঙ্গের, কালকিনির চর, চর শাহজালাল, টাগরার চর, ডবা চর, গাগোরিয়া চর, চর গাজীপুর, কালুপুর চর, চর মনপুরা, পাতার চর ও উড়ির চর; চট্টগ্রাম বিভাগের চর বারী, বাটা চর, গাউসিয়ার চর, মৌলভীর চর, মুহুরী ড্যাম, মুক্তারিয়া চর, ঢাল চর, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ; সিলেট বিভাগের আইলার বিল, ছাতিধরা বিল, হাইল হাওর বাইক্কা, হাকালুকি হাওর, পানা বিল, রোয়া বিল, শনির বিল ও টাঙ্গুয়ার হাওর। শীত এলেই এসব জলাশয়সহ বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, বিল ও পুকুরের পাড়ে চোখে পড়ে নানা রং-বেরঙের নাম জানা, অজানা পাখির। বাংলাদেশের হাওর এলাকা ও বিস্তৃত সুন্দরবন এলাকা পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আকর্ষণ।
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শীতের এই পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই ওরা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির পরিযায়ী পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় আনাগোনা দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, মহেশখালী দ্বীপ, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, চরভাটা, শিবালয়, হালহাওর, হাকালুকি হাওর, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, চর ওসমান, শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওরহাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর যামিরচর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, চর কুকড়ি মুকড়ি, গলাচিপা, খেপুপাড়া, জোনাকচর, বুড়ীগঙ্গা নদী, হোয়াইকিয়ং, শাহপরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম, চরমানিক, চরদিয়াল, আগুনমুখা প্রভৃতি। তবে বাংলাদেশের দিকে এ উড়ালপথে জনবসতি বেশি হওয়ায় এবং মানুষের অত্যাচারে পরিযায়ী পাখিদের আগমন কমতে বসেছে।
অতিথি পাখি আমাদের জন্য আশির্বাদ স্বরুপ। অতিথি পাখিদের আগমন আমাদের প্রকৃতিতে আনন্দের আমেজ এনে দেয়৷ এদের আগমনে আমাদের প্রকৃতি সৌন্দর্যে ভরে উঠে। এরা যে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তা নয়। এরা বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেয়ে আমাদের ফসলকে রক্ষা করে। অতিথি পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে।
তবুও এসব পাখি বে-আইনিভাবে শিকার হচ্ছে। অতিথি পাখি আমাদের বন্ধু, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব, আমাদের প্রেরণা। এ পাখিগুলোকে অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের বন্ধুসুলভ আচরণ করা দরকার। এই পাখিগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
কিছু অসাধু মানুষের জন্য অতিথি পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। তারা শুধুমাত্র খাবার জন্য অতিথি পাখিদের শিকার বানাচ্ছে। এদের মাংসকে অনেকে সুস্বাদু বলে মনে করে। এছাড়াও, অনেকেই পাখির পালক সংগ্রহ করে। অতিথি পাখি শিকারের ফলে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাখি শিকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, জাল ও বন্দুক ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও, পরিবেশ দূষণ, জলাভূমি ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও অতিথি পাখিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে।পরিযায়ী পাখি নিধন এবং বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক গলিয়ে এক শ্রেণির পেশাদার এবং শৌখিন শিকারি কাজগুলো করে চলেছে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। তখন নির্ভর করতেই হবে কীটনাশকের ওপর। কিন্তু এটি তো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি বেশি, সে দেশের পরিবেশও সুস্থ। পাখি দেখতে পর্যটকও বেশি আসে। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার। পাখি নিসর্গকে সুন্দর করে, চোখকে প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে আলোড়িত করে। পাখিরা আসুক, ওদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। আর আমরা পরিযায়ী পাখিদের শিকার না করে, পাখিদের উৎপাত না করার মাধ্যমে তাদের প্রতি সদয় হয়ে বাড়িয়ে দিই আমাদের মানবিক আচরণ।
পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। তারা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই আমাদের উচিত পাখি রক্ষার জন্য সচেতন হওয়া। পাখি শিকার বন্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। অতিথি পাখিদের রক্ষায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। অতিথি পাখি শিকারের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন সংগঠন অতিথি পাখি রক্ষায় কাজ করছে। এই পদক্ষেপ গুলো যথেষ্ট নয়। অতিথি পাখি রক্ষার জন্য আমাদের জনমত গড়ে তুলতে হবে। অতিথি পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে। অতিথি পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে বুঝাতে হবে।