রবিবার ● ১ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মিডিয়া » গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি কম
গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি কম
জেন্ডার বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি কম। শীর্ষ পদগুলোতে উপস্থিতি আরও কম। সংবাদ মাধ্যমে সব সময় প্রতিটি পর্যায়ে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করা হয় না বলেও অভিযোগ উঠে আসে বক্তব্যে। ১ ডিসেম্বর রোববার রাজধানীর দ্য ডেইলী স্টার ভবনে মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) আয়োজিত ‘সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা এ সব বক্তব্য তুলে ধরেন।
বক্তারা বলেন, গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হবে, দূর করতে হবে গণমাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য। নারীদের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদায়ন করতে হবে। দিতে হবে সব ক্ষেত্রে সার্বিক নিরাপত্তা।
এমআরডিআই নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস ‘সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ প্রকাশ’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। জেন্ডার চার্টার্র ওয়ার্কিং গ্রুপ জানিয়েছে, মোট ২০ টি গণমাধ্যম এই সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া আরো দুটি টিভি চ্যানেলের এই অঙ্গীকার সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রধান অতথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বলেন, ‘মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা। গণতন্ত্রের জন্য নারী ও পুরুষকে সমানভাবে চিত্রিত করা অত্যাবশ্যক’।
তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে নি:সন্দেহে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সহনশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যমে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। মানসম্মত সাংবাদিকতা নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি।
স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, এই সনদ করা হয়েছে নারীসহ সব লিঙ্গভিত্তিক মানুষের জন্য ন্যায্য ও সমতার ক্ষেত্র প্রস্তত করতে। যাতে সংবাদ মাধ্যমে সব জেন্ডারের ন্যায্য ও সংবেদনশীল উপস্থিতি থাকে। সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তিনি আহ্বান জানান, যেনো এই জেন্ডার অঙ্গীকার সনদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নীতিমালা তৈরি করে। গৎ বাঁধা ধারণার বাইরে জেন্ডারের কথা ও দৃষ্টিকোণ থেকে যেন সংবাদ তৈরি করা হয়।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং জেন্ডার চার্টার ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের মধ্যে এবং পরিবেশিত সংবাদে নারী, পুরুষ ও অন্যান্য জেন্ডারের উপস্থিতির ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সংবাদমাধ্যমের জন্য জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিষয়ে একটি অঙ্গীকার সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই সনদ সংবাদ প্রতিষ্ঠানে এবং তাদের পরিবেশিত সংবাদে সব জেন্ডারের উপস্থিতি, অংশগ্রহণ এবং সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ করবে।
এই সনদে বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক ঐকতানের মধ্যে বিবেচনা করার প্রচেষ্টা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, বৈচিত্র্যময় কর্মে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও গণমাধ্যমে নারী অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। গণমাধ্যমে সব জেন্ডারের মতামত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে, যদিও অনেক গণমাধ্যমে তা নেই।
তিনি বলেন, ৯০ সাল থেকে আমরা এখন এখানে। জেন্ডার এমন একটা বিষয় যা প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত পরিবর্তন না করে উপায় নাই। মতানৈক্য ছিল। তবে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ঐকমতে এসেছি। আমরা চাই না, নারী বলে কোনো নারী সাংবাদিক যেন বঞ্চিত বা হেয় শিকার হোক। নিরাপদ, কর্মমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য আমি বলছি কম, শুনছি, পড়ছি ও জানার চেষ্টা করছি বেশি। আর যাতে কোন গণমাধ্যম অফিস পুড়িয়ে দেওয়া না হয় সেজন্য কি করা যায় সেটা নিয়ে একটা নীতিগত অবস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার সংস্কারের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেটারও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। কোন কিছুই গণমাধ্যমে চাপিয়ে দিলে হবে না। সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে এই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান বলেন, এই জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ সকল গণমাধ্যম কর্মীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। জেন্ডার বিবেচনায় বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সকল সীমাবদ্ধতা জয় করে এগিয়ে যাবে নারীরা।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, বাংলাদেশে দুটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। একটি ৯০ এ, আরেকটি এই ২৪ এ। ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল হাতে গোনা। তবে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। তিনি বলেন, টেলিভিশনের নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বাড়লেও দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমে সে তুলনায় কম। মালিক এবং সম্পাদক দুই পক্ষের মাধ্যমেই গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
পিআইবি’র মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, নতুন কোন গণমাধ্যম বাজারে আসার পর তাদের কর্মীদের জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ ও জেন্ডার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত পিআইবি। গণমাধ্যমে কাউকে একক ক্ষমতাবান করা উচিত নয়। গণমাধ্যমে কর্মীদের স্বার্থে একদিন নয় দু’দিন ছুটি চালু করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।
চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র নিউজ এডিটর মীর মাশরুরুজ্জামান রনি বলেন, গণমাধ্যমে জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সঙ্গে বিনিয়োগ জড়িত আর বিনিয়োগের বিষয়টি এলে মালিকানার বিষয়টিও আসে। একজন নারী সহকর্মীর জন্য নানা ধরনের পরিবর্তন সংযোজন প্রয়োজন হবে যেটা অনেক মালিকে করতে চাইবেন কিনা প্রশ্ন। আমাদের নিউজ রুম সংস্কৃতি অনেক পুরাতন যখন নারীদের গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ ছিল হাতে গোনা। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নিউজ রুম সংস্কৃতিতেও আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে।
চ্যানেল২৪ এর নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন বলেন, গণমাধ্যম খুবই চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এই সনদ বাস্তবায়িত হলে গণমাধ্যম কর্মীরাই উপকৃত হবেন। স্বাক্ষরটাই শেষ কথা না, এটা বাস্তবায়ন করাই মূল বিষয়। তবে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটার শুরু হলো।
যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ বলেন, যমুনা টেলিভিশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করছে অনেক নারী কর্মী। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কখনও কোন অভিযোগ উঠেনি। কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি পারিবারিক সহযোগিতাও নারীদের এগিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা, অধিকার কর্মী হোচিমিন ইসলাম, যশোর থেকে প্রকাশিত লোক সমাজ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনোয়ারুল কবির নান্টু, যশোরের গ্রামের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সোনার দেশ পত্রিকার সম্পাদক হাসান মিল্লাত।
জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ প্রণয়নে এমআরডিআই’র উদ্যোগে সাংবাদিকতার শিক্ষক, সংবাদমাধ্যমের সিদ্ধান্ত গ্রহীতা, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী এবং জেন্ডার ও আইন-বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১০ জনের একটি দল গঠন করা হয়। সেই দল ১১টি বৈঠকের মাধ্যমে সনদটি তৈরির কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ এবং প্রতিটি স্তরে পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত সনদ প্রণয়নের জন্য কাজ করে। সনদ প্রণয়নে ১৫টি দলভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাজধানী ও জেলা পর্যায় থেকে ১২৯ অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়।(বাসস)