সোমবার ● ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বাস্ততন্ত্রে পাখির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে
বাস্ততন্ত্রে পাখির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি জাতীয় পাখি দিবস পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে কমছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা। চোরা শিকারিদের হাত থেকে পাখিদের কীভাবে রক্ষা করতে হবে, সেই প্রতিজ্ঞা প্রত্যেক বছর করা হয় এই জাতীয় পাখি দিবসে। এই দিনটি প্রকৃতি ও পাখি প্রেমীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত পাখিদের নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই এই দিনটি উদযাপন করা হয়।
১৮৯৪ সালে অয়েল সিটির স্কুল সুপারিনটেনডেন্ট চার্লস আলমানজো ব্যাবকক দ্বারা পাখি দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাবকক এটিকে একটি নৈতিক মূল্য হিসেবে পাখি সংরক্ষণকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য করেছিলেন। এটি প্রতি বছরের ৪ মে পালিত হয়। তবে এতে জনসচেতনতা আশানুরূপ না বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০২ সাল থেকে তারা ক্রিসমাসের ছুটিতে একটা দিন পাখি দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০০২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি জাতীয় পাখি দিবস হিসেবে পালন করে। সেই দিবসের আলোকে ভারত ও বাংলাদেশও ৫ জানুয়ারিকে পাখি দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারিভাবে স্বীকৃত না হলেও প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি ব্যক্তি বা বিভিন্ন সংগঠন পর্যায়ে জাতীয় পাখি দিবস পালন করা হয়। দিনটি প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পাখি দিবস হল পাখি সম্পর্কে চিন্তা করার একটি সময়, তারা কীভাবে বাস করে, তাদের কী প্রয়োজন এবং আমরা তাদের সাথে কীভাবে আচরণ করি।
বর্তমানে বিশ্বের ২০ শতাংশেরও বেশি পাখি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। সংখ্যার নিরিখে যা প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির সমান। এই বিশাল সংখ্যক প্রজাতিকে বাঁচাতেই জাতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাখি প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। মূলত পাখি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই এই দিনটি উদযাপন করা হয়। নগরায়ণ ও নানা কারণে পাখিদের সংখ্যা দিন দিন কমছে শহর এলাকায়। এ ছাড়া নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ইকোসিস্টেম। সেই ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতেই এই বিশেষ দিন। এ ছাড়া পাখি ধরা, খাওয়া, বিক্রয়, বিপণন নিষিদ্ধ করা ও এ সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সচেতন করতে উদযাপন করা হয়।
প্রকৃৃতির অন্যতম সুন্দর সৃৃষ্টি পাখি। সূর্যদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, তেমনি তাদের রংবেরংয়ের ডানাও মন কেড়ে নেয় মানুষের। পাখির অদ্ভুদ সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাস্ততন্ত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই বাস্তুতন্ত্র কার্যত অচল পাখি ছাড়া। বর্তমানে শিকার থেকে দূষণ, একাধিক কারণে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রত্যেককে হাতে হাতে মিলিয়ে পাখি সংরক্ষণের উপর জোর দিতে হবে। বাস্তুতন্ত্রের সমতা বজা রাখতে পাখি সংরক্ষণ করতে হবে জোরদারভাবে।
বিশ্বের প্রায় ১০ হাজার পাখির প্রজাতির প্রায় ১২ শতাংশ আগামী শতাব্দীর মধ্যে বিলুপ্তির মুখোমুখি হতে পারে, যার মধ্যে বিশ্বের ৩৩০টি তোতা প্রজাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে। পাখি গবেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে কয়েকটি পাখির জাত বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরে কয়েকটি পাখির জাত একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (আইইউসিএন) সর্বশেষ পাখি নিয়ে জরিপ ২০১৫ অনুযায়ী, ওই সময়ের জরিপে বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতির অস্তিত্ব খুঁজে পায় সংস্থাটি। তবে বর্তমানে দেশে ৭০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এ ৭০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ২২০ থেকে ২৩০ প্রজাতি হলো পরিযায়ী পাখি। বাকিগুলো দেশীয় পাখি। আইইউসিএন বলছে, গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৯ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে লালমুখ দাগিডানা, সারস, ধূসর মেটে তিতির, বাদা তিতির, বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিলা, মদনটাক, ধলাপেট বগ, সাদাফোঁটা গগন রেড, রাজশকুন, দাগি বুক টিয়াঠুঁটি, লালমাথা টিয়াঠুঁটি, গাছ আঁচড়া ও সবুজ ময়ূর। বাংলাদেশে যেসব প্রজাতির পাখি রয়েছে, তার মধ্যে জলচর পাখি রয়েছে ২০০ প্রজাতির।
বাসস্থান ও খাদ্য সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়নসহ নানা কারণে কাক, চিল পেঁচাসহ অনেক প্রাণীই শহর থেকে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। মাত্র ১০ বছরে কাকের সঙ্গে অন্য পাখির সংখ্যাও কমে গেছে। বড় গাছপালা কেটে আবাস্থল তৈরি হচ্ছে। কাক-চিল এসব পাখি বড় বড় পুরোনো গাছে বাসা তৈরি করে। বড় বড় পুরোনো গাছে কমে যাওয়ার কারণে বাসা হারাচ্ছে কাক ও চিল। তাদের প্রজননে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। প্রাকৃতিক চক্র বা বাস্তুসংস্থান বিপন্ন হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাখিদের সৌন্দর্য, গান এবং উড়ান দীর্ঘকাল ধরে মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। পাখি হল সেন্টিনেল প্রজাতি যাদের দুর্দশা বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত অসুস্থতা সনাক্ত করার জন্য বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য এবং সতর্কতা ব্যবস্থার ব্যারোমিটার হিসাবে কাজ করে। অবৈধ পোষা প্রাণীর ব্যবসা, রোগবালাই এবং বাসস্থানের ক্ষতির কারণে বিশ্বের অনেক তোতাপাখি এবং গানের পাখি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। পাখিদের শারীরিক ও আচরণগত চাহিদা সম্পর্কে জনসচেতনতা এবং শিক্ষা প্রয়োজন। পোষা পাখি বা বন্দিদশায় রাখা লাখ লাখ পাখির কল্যাণে কাজ করা। বিশ্বের পাখিদের বেঁচে থাকা এবং মঙ্গল নির্ভর করে জনশিক্ষার উপর এবং সংরক্ষণের জন্য জনসমর্থনের দরকার।
জাতীয় পাখি দিবস হল এমন একটি দিন যা আমরা আমাদের আশেপাশে যে পাখিদের সাথে ভাগ করে নিই কেবল তাদের প্রশংসা করার জন্য নয়, বরং সর্বত্র সমস্ত পাখির কথা চিন্তা ও প্রশংসা করার দিন। দুর্ভাগ্যবশত, পাখিরা তাদের কল্যাণের বিষয়ে সামান্য চিন্তা করেই বিভিন্ন উপায়ে শোষিত হয়। এগুলি গবেষণায় ব্যবহার করা হয়, তবে অন্যান্য প্রাণীর মতো প্রাণী কল্যাণ আইনের আওতায় পড়ে না এবং এগুলিকে খাদ্যের জন্য হত্যা করা হয়, তবুও বধ আইনের মানবিক পদ্ধতির অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অতিরিক্তভাবে, প্রতি বছর, লক্ষ লক্ষ পাখি বন্য অঞ্চলে বন্দী হয় বা বাণিজ্যিক লাভ, পোষা প্রাণী হিসাবে ব্যবহার এবং বিনোদনের জন্য বন্দীদন্ডে প্রজনন করা হয়, এই প্রাণীগুলিকে দুর্দশায় ফেলে দেয়। পাখি দিবস হল বন্দিদশায় থাকা পাখিদের জীবন উন্নত করার এবং বন্য অঞ্চলে পাখিদের রক্ষার লক্ষ্যে সহায়তার প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার একটি সময়।
আমাদের দেশে ঋতুভেদে ভিন্ন পাখি দেখা যায়। এ ছাড়া একই পাখি প্রজননের সময় ও পরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায়। প্রকৃতির মাঝে থাকাটাই আনন্দের তবে প্রকৃতির প্রাণ পাখির মাঝে থাকা আরও আনন্দের। তাদের শিকার করার পদ্ধতি, উড়ার পদ্ধতি, যৌনাচরণ সবকিছুই আকর্ষণীয় ও সুন্দর। এ ছাড়া বিপন্ন, অতিবিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ পাখিদের সংরক্ষণের বিভিন্ন পন্থা সম্পর্কে সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুব দরকার। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পাখির জন্য ভালোবসা শেখাতে ও এতদসম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সচেতন করতে আমাদের পাখি দিবস পালন করা উচিত।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট