শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

SW News24
শনিবার ● ২৫ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম
প্রথম পাতা » মুক্তমত » পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম
১১ বার পঠিত
শনিবার ● ২৫ জানুয়ারী ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম

 --- জীববৈচিত্র্য,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য জলাভূমির ভূমিকা অপরিসীম। পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো জলাভূমি। ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য,পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি।
জলাভূমি হলো এমন একটি স্থান বা এলাকা, যার মাটি মৌসুমভিত্তিক বা স্থায়ীভাবে আর্দ্র বা ভেজা থাকে। রামসার কনভেনশন অনুযায়ী জলাভূমি বলতে বোঝায় নীচু ভূমি। যার পানির উৎস প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম, পানির স্থায়িত্বকাল সারাবছর কিংবা মৌসুমভিত্তিক, পানি স্থির কিংবা গতিশীল, স্বাদু, আধা-লবণাক্ত বা লবণাক্ত, এছাড়াও কম গভীরতাসম্পন্ন সামুদ্রিক এলাকা যার গভীরতা ৬ মিটারের কম ও অল্প স্রোতযুক্ত।

পৃথিবীর প্রায় ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ ভূভাগ জলাভূমির অন্তর্গত। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ১৭৫টি জলাভূমি রয়েছে যুক্তরাজ্যে। সবচেয়ে বেশি জলাভূমির অন্তর্গত ভূভাগ রয়েছে রাশিয়াতে, যা প্রায় ১৪ কোটি হেক্টরেরও বেশি। পৃথিবীর ২৫৬,১৯২,৩৫৬ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ২,৪৭১টি স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে  অসংখ্য খালবিল, নালা, পুকুর-ডোবা রয়েছে। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী। বিশ্বের মোট জলাভূমির প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়েছে। বাকি জলাশয়গুলোও হুমকির মুখে। এসব জলাভূমি মোট প্রাণী প্রজাতির ৪০ শতাংশের আশ্রয়স্থল।

১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী ইরানের রামসার শহরে ১ম জলাভূমি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে জলাভূমির উপযোগিতা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্ব জলাভূমি দিবস ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে সাংবার্ষিক আকারে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে। জলাভূমি সংক্রান্ত সম্মেলনে সাক্ষর গ্রহণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিবস পালন। রামসার কনভেনশন হলো বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়। এখন পর্যন্ত ১৭২টি দেশ এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। রামসার কনভেনশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে ইউনেসকো।

জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য জলাভূমির ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ রামসার কনভেনশন চুক্তিতে সই করে। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশে রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ। ১৯৯২ সালে সুন্দরবন ও ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাংলাদেশের রামসার স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

দেশের জলাভূমিগুলো জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। এগুলো মানববসতি, জীববৈচিত্র্য, মাছ উৎপাদন, কৃষি বহুমুখীকরণ, নৌ চলাচল ও যোগাযোগ এবং প্রতিবেশ-পর্যটন ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের জলাভূমি গত ৫০ বছরে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ১৯৭১ সালে জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৯৩ লাখ হেক্টর। তা কমে এখন হয়েছে ২৮ লাখ হেক্টর। ৬৫ লাখ হেক্টর জলাভূমি কমেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং ন্যাচার কনজারভেশন মুভমেন্ট পরিচালিত এক যৌথ গবেষণা মোতাবেক ৫ হাজারেরও বেশি সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ১৫০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী দেশের জলাভূমিগুলোতে পাওয়া যায়। ৪০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ তাদের জীবনকালের পুরো অংশ বা আংশিক সময়কালের জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল থাকে।বাংলাদেশের বড় সংখ্যক প্রাণী প্রজাতি জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ৬৪ প্রজাতির উভচর, ৮৩ প্রজাতির সৈকত পাখি, ৩০ প্রজাতির বুনোহাঁস, আট প্রজাতির শামুকখোল, ১৮ প্রজাতির বগলাসহ অসংখ্য প্রজাতি এর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এ ছাড়া প্রতি বছর শীতের সময় বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে, যাদের আবাসস্থল ও খাবার দুটোই জলাভূমিকে কেন্দ্র করে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জলাভূমিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। জলাশয় হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি নির্মাণ, জলাশয়ে পয়ঃপ্রণালি স্থাপন, বিভিন্ন তরল ও কঠিন বর্জ্য নির্গমন, বালু-পাথর আহরণ ইত্যাদি। এ ছাড়া ঝিনুক, মাছ, কচ্ছপ প্রভৃতি ধরা-মারাও জলাশয়ের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানববসতি স্থাপনে জমির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানববসতি স্থাপনে জমির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। নগরীর আশপাশের জলাভূমি মানববসতি স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে; যার ফলে অনেক জলাভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়। এটি পরিবেশ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য সরকার ২০০০ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে প্রাকৃতিক জলাধার নদী, খান, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসাবে মাস্টারপ্ল্যান চিহ্নিত বা সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং সলিল পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিকে বোঝানো হয়েছে। এ আইনের বিধান অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এ ধরনের জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পানির চাহিদা, বন্যা ও খরার ঝুঁকিতে  টেকসই উন্নয়নে জলাভূমির ভূমিকা  তাৎপর্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ যে কার্বন নিঃসরণ, তা কমানোরও এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি জলাভূমিগুলো। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে সেগুলোকে অপসারণের মাধ্যমে উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করাকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন করে। জলাভূমিগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন এবং প্রশমন এর সমন্বয় ব্যাবস্থা। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, জলাভূমিগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন রিজারভার। জলাভূমিতে পৃথিবীর প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ টেরেস্ট্রিয়াল কার্বন জমা রয়েছে। যদি জলাভূমিগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। জলাভূমি কার্বন সিংক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

প্রতিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। জলাভূমি রক্ষা করতে না পারলে শুধু প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্র। তাই জলাভূমিগুলোর সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)