শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

SW News24
রবিবার ● ২৬ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » বিদ্যাদাত্রী দেবী সরস্বতী
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » বিদ্যাদাত্রী দেবী সরস্বতী
১৭ বার পঠিত
রবিবার ● ২৬ জানুয়ারী ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বিদ্যাদাত্রী দেবী সরস্বতী

---
প্রকাশ ঘোষ বিধান

বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। সনাতন ধর্মাবম্বীদের মতে দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতিক। বিদ্যা, বানী ও সুরের অধিষ্ঠাত্রী। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসে পঞ্চম তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীপঞ্চমী বা বসন্তী পঞ্চমী নামে তিথিটি পরিচিত।
হিন্দু ধর্মানুসারীদের বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি আনন্দঘন দিন হচ্ছে সরস্বতী পূজা। প্রতি বছর মাঘ মাসের শুল্ক পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সনাতন ধর্ম মতে ঈশ্বরের বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী প্রজ্ঞাশক্তিরূপ দেবী মাতা সরস্বতী। ঈশ্বর সকল ধরনের শক্তির উৎস। হিন্দু দর্শনমতে তিনি যখন জ্ঞানদাতা হিসেবে কাজ করেন তখন তাকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। মা যেমন স্নেহবাৎসল্যে, সোহাগে শিশুকে জন্মের পর থেকে আধোআধো বুলির মাধ্যমে পৃথিবীর জ্ঞান প্রথম তার শিশুকে প্রদান করেন তেমনি ঈশ্বর মাতৃরূপেই আমাদের জ্ঞান দান করেন। যিঁনি মানুষের অন্তরে মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং মেধা ও মননকে দীপ্তি দান করেন

পদ্মপুরাণের সুবিখ্যাত সরস্বতীস্তোত্রম্ -এ দেবীর শ্বেতশুভ্র মাধুর্যমণ্ডিত রূপ বর্ণিত হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধানুলেপন দ্বারা শোভিতা। তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে বিভূষিতা।

শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।
দেবী সরস্বতীর গায়ের বর্ণ শ্বেত-শুভ্র। বিদ্যা যেহেতু সাত্ত্বিক এবং নিষ্কলুষ হতে হয় ; তাই সেই সকল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেবী সরস্বতীও শুভ্রমূর্তিতে বিরাজিতা। বিদ্যা লাভের জন্য প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের আগে বাল্যকাল থেকে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তবেই সে মুক্তিস্বরূপা বিদ্যা লাভ করবে।

শ্রীচণ্ডীতে বিদ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।। (শ্রীচণ্ডী:০১.৫৭-৫৮)
“সেই মহামায়া দ্বিবিধা, বিদ্যা ও অবিদ্যা। যে মহামায়া মুক্তির জননী, তিনি বিদ্যা। আর যিনি সংসার বন্ধনের কারণস্বরূপা, তিনি অবিদ্যা। যিনি মুক্তির জননী, তিনিই সনাতনী পরমা বিদ্যা। তিনিই সংসার-বন্ধের কারণ-স্বরূপা এবং তিনিই মনুষ্য দেবতাসহ সকলের পরমেশ্বরী।”

দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। রাজহাসেঁর মধ্যে এক অনন্য সক্ষমতা আছে, সে জল এবং দুধের মিশ্রণ থেকে দুধকে আলাদা করে নিতে পারে। জগতে বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়ই আছে, সেই পঙ্কিলতাপূর্ণ তামসিক অবিদ্যা থেকে আমাদের বিদ্যাকে গ্রহণ করে নিতে হবে। দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা । তিনি কলা ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। দেবীর হাতে বীণা সমৃদ্ধ শিল্পকলা চর্চার প্রেরণা দেয়। কলা বিদ্যার চর্চা মানুষকে বিভিন্ন নৃশংস অপকর্ম থেকে দূরে রেখে প্রচণ্ডভাবে মানবিক করে তোলে। দেবীর হাতে পুস্তক ধারণ করে আছেন। সরস্বতী পূজাতেও দেবীর শ্রীচরণে পাঠ্যপুস্তক সমর্পণ করে বিদ্যা যাচনা করা হয়। এ বেদাদি পুস্তক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জ্ঞানের আশ্রয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিপূজা করে না, তাঁরা মূর্তিতে পরমেশ্বরের উপাসনা করে। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে মূর্তিকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করে উপাসনা করে। অর্থাৎ মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী প্রতিমাতে রূপান্তরিত করে উপাসনা করে। প্রতিমার সৌন্দর্যে, পূজার বিশেষত্বে এবং সাধকের সুতীব্র বিশ্বাস ও ভক্তিতেই মৃন্ময়ী, দারুময়ী, শিলাময়ী বা ধাতুময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়।

সরস্বতী সর্বশুক্লা, তাঁর শ্রীহস্তে বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তাদি, তিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তিনি সকল তমঃ নাশ করেন, তিনি বাগ্দেবতা, তাঁর নয়ন বিশাল ও পদ্মের ন্যায়, তিনি সকল ঐশ্বর্যের সিদ্ধিদায়িনী। বেদে সরস্বতী সম্পর্কে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে। বেদোক্ত সরস্বতীর তিন রূপ- ভূঃ বা ভূলোকে ইলা, ভুর্বঃ বা অন্তরীক্ষলোকে সরস্বতী এবং স্বও বা স্বর্গলোকে ভারতী। ভূঃ র্ভুবঃ স্বঃ- এই তিন মিলেই সামগ্রিক জগত। ভূলোকে অগ্নি, অন্তরীক্ষ লোকে ইন্দ্র এবং স্বর্লোকে সূর্য-এ তিনের যে জ্যোতিরাশি তা সরতীরই জ্যোতি। জ্ঞানময়ী বা চিন্ময়ীরূপে তিনি সর্বত্র, সর্বব্যাপিনী। তাঁর অমিয়ধারা বিশ্বে বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। সে প্রভাময় আলোক জগতের জমাটবাঁধা তমোরাশি অপনীত করে। তার জ্যোতির জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিঃই প্রণব, এই জ্যোতিইঃ সরস্বতী, তিনিই ঈশ্বর। পরমেশ্বর যখন জ্ঞানময় তখন তিনি সরস্বতী।

হিন্দুশাস্ত্র মতে বিদ্যা দুই প্রকার- পরাবিদ্যা আর অপরা বিদ্যা অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও পার্থিব জ্ঞান এই উভয় জ্ঞানই মানুষকে তার জীবদ্দশায় অর্জন করতে হয়। জ্ঞানসাধনার সাথে আত্মিক ক্রমবিকাশের সম্পর্ক নিবিড়। সরস্বতী পূজার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের ক্ষুদ্র গন্ডী অতিক্রম করে বৃহৎ জ্ঞানসমুদ্রে বিচরণ। সরস্বতীর শ্বেতশুভ্র ভূষণের ন্যায় নিজের সকল কালিমা স্বচ্ছ আলোয় ধূয়ে, মনের মলিনতাকে পরিহার করে ব্যবহারিক জীবন ও পারলৌকিক জীবনের পরিপূর্ণতাই সরস্বতী পূজার মহান আদর্শ। পদ্মে আসীনা মাতা সরস্বতী কেননা মানুষ জ্ঞানরূপ চক্ষু দ্বারা নিজের জগতে শতদলের মতো প্রস্ফুটিত করবে, সকল অশুভকে পরিহার করে শতদলের ন্যায় আলোয় উদ্ভাসিত হবে।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)