

মঙ্গলবার ● ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন
বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন
চির রহস্যময় এক অরণ্য সুুন্দরবন। পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত বনভূমি সুন্দরবন। হিমালয়ের পলিযুক্ত পানিকণা প্রবাহ হতে হতে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার কালে সমুদ্রতীরে যে চরের সৃষ্টি করেছে, সেখানেই গড়ে উঠেছে এই সুন্দরবন।সুন্দরবনকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা এবং কাদা চর। সুন্দরবনের অন্য নাম বাদাবন।সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণিবৈচিত্র্য বিদ্যমান। সুন্দরবনকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয়।
সুন্দরী বৃক্ষের প্রাচুর্যের জন্য এই বনের নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন। দ্বীপমালা সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানান মত। অনেকে মনে করেন, নামটির আক্ষরিক অর্থেই নিহিত রয়েছে সারমর্ম। সুন্দরবন অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরবন নামের সম্ভাব্য আরেকটি উৎস মনে করা হয় সমুদ্রকে। সমুদ্রের তীরে বনের অবস্থান বলে সমুদ্র বন থেকে কালক্রমে এর নাম হয়েছে সুন্দরবন এমনটি ধারণা করেন অনেকে। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদাবন, হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল হিসেবে পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় এই বাদার নাম হয়ে যায় মহাল, মধুমহাল, গোলমহাল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সুন্দরবন ৯ নং সেক্টরের অধীনে ছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সুন্দরবনও ভাগ হয়ে যায়। এর এক অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। অপর অংশ বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত এই প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন বন অধিদপ্তরের মতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কি.মি. বা ২ হাজার ৩২৩ বর্গমাইল। যার ৬৯% স্থলভাগ ও ৩১% জলভাগ। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা অবস্থিত। মাত্র ৯৫ বর্গকিলোমিটার পটুয়াখালী ও বরগুনায় অবস্থিত। সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো পশুর, শিবসা, রায়মঙ্গল, বলেশ্বর প্রভৃতি। সুন্দরবনের পূর্বে বলেশ্বর এবং পশ্চিমে রায়মঙ্গল। সুন্দরবন অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদী হাড়িয়াভাঙ্গা।
সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন। জাতিসংঘের ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনের তিনটি প্রাণী-অভয়ারণ্য পূর্বাঞ্চলীয় সুন্দরবন, পশ্চিমাঞ্চলীয় সুন্দরবন ও দক্ষিণাঞ্চলীয় সুন্দরবন নিয়ে গঠিত ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৭ শত হেক্টর বনাঞ্চলকে বিশ্বঐতিহ্য ঘোষণা করে। এটি ৫২২তম বিশ্বঐতিহ্য। ইউনেস্কো আবার সুন্দরবনকে দুই ভাগে ভাগ করে। ভারতীয় অংশকে বলে সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক। আর আমাদের অংশকে বলে সুন্দরবন। সুন্দরবন হচ্ছে গোটা পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত কানন। এটি টাইডাল বা জোয়ার-ভাটার বনও। বাংলাদেশের একক বনভূমি হিসেবেও এটি বাংলাদেশের জাতীয় বন। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।
সুন্দরবনের নদ-নদীর সংখ্যা অগণিত যা পুরো সুন্দরবনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবার ৬ ঘণ্টা করে দুইবার জোয়ার ও দুইবার ভাটা হয়। এ কারণে এখানকার বৃক্ষ-লতা বিশ্বের যেকোনো জঙ্গল থেকে আলাদা ধরনের। এ বনের অন্যতম নদী পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মঙ্গলসহ প্রায় ৪ শত নদ-নদী, খাল-নালাসহ ২শতটি ছোট-বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে যশোরের জজ ম্যাজিস্ট্রেট টিলম্যান হেংকেলের সময় সুন্দরবন জমিদারদের দখলমুক্ত হয়ে জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবনের শাসনব্যবস্থা আলাদাভাবে দেখানো হয়। লেফটেন্যান্ট হজেস ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবন জরিপ করেন। আলীপুরে সুন্দরবন বিভাগের সর্বপ্রথম হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়। সুন্দরবন সর্বপ্রথম পোর্ট-ক্যানিং কোম্পানিকে বছরে ৮ হাজার টাকায় বন্দোবস্ত দেয়া হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গভর্নমেন্ট সুন্দরবনের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেস্ট মি. শ্লিট বন বিভাগের আর্থিক গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল সুন্দরবনের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করেন এবং সুন্দরবনের জন্য স্বতন্ত্র বিভাগের সৃষ্টি করা হয়। ১৮৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুন্দরবনে সংরক্ষিত বন ব্যবস্থাপনার গোড়াপত্তন হয়। ১৮৬৫ সালের বন আইনের ২ নং ধারা অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ তারিখে বর্তমান খুলনা এবং বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। মাত্র ৮৮৫ স্কয়ার মাইল জঙ্গল সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়। ১৮৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে আরো ৩১৪ বর্গ মাইল এলাকা বৃদ্ধি করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র এলাকা সংরক্ষিত হয়ে সরাসরি সরকারের তত্ত্বাবধানে আসে। সুন্দরবন এলাকায় ধীরে ধীরে লোকালয়ের মতো আইন-কানুন চালু হতে থাকে। বর্তমানে সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ২টি বন বিভাগ বাগেরহাট পূর্ব বন বিভাগ ও খুলনা পশ্চিম বন বিভাগ। চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জ আছে- চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা। রয়েছে ১৬টি বন স্টেশন। ৯টি ব্লক ও ৫৫টি কম্পার্টমেন্ট।
১৯০৩ সালে মিস্টার ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় সুন্দরবনে। আজ পর্যন্ত জানা প্রায় ৫০টির অধিক প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়।
সুন্দরবন নানা ধরণের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের সংখ্যা প্রায় ২০০। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটিসহ অসংখ্য উপকূলীয় পাখি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। সমুদ্র এবং বড় বড় নদীর উপকূলভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাংচিল, জলকবুতর, টার্ন ইত্যাদি। চিল, ঈগল, শকুন ইত্যাদিরও দেখা পাওয়া যায় সুন্দরবনে। এ বনে মাছরাঙার দেখা মেলে প্রতিনিয়তই। এছাড়া, কাঠঠোকরা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট গায়ক পাখি। সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যও সীমাহীন। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হলো মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত মৌয়ালদের পেশা মধু সংগ্রহ করা। তারা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বন থেকে মধু সংগ্রহ করে। সর্বশেষ জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে ১১৪ টি বাঘ, ১লাখ থেকে ১ লাখ ৫০হাজার চিত্রা হরিণ, ২০ হাজার বানর এবং ২০ হাজার থেকে ২৫হাজার বন্য শুকর রয়েছে।
অপার সৌন্দর্যের সুন্দরবন। বিচিত্র জীববৈচিত্র্যের আধার, বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবন। বনজ সম্পদ, কর্মসংস্থান, প্রাণী ও উদ্ভিদ বিচিত্রতা, মৎস্য সম্পদ, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, বিভিন্ন প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভূমিকা বলে শেষ করার মত না। তবে সুন্দরবনের নানা ধরনের বনজ সম্পদ ও নানা প্রজাতির পশু, পাখি, মাছেরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি-স্বরূপ। দেশের উন্নয়নের জন্য সুন্দরবনের বনজ সম্পদ ও বন্য-প্রাণীদের সংরক্ষণের প্রতি দেশের মানুষের উচিত আরও বেশী মনোযোগ দেয়া।