

বুধবার ● ৫ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » প্রতারণার ফাঁদে ভোক্তা অধিকার হারাচ্ছে
প্রতারণার ফাঁদে ভোক্তা অধিকার হারাচ্ছে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
অর্থনীতিতে যে ব্যক্তি ভোগ করে তিনিই ভোক্তা। কোনো অবাধ সহজলভ্য দ্রব্য ছাড়া অন্য সব দ্রব্য ভোগ করার জন্য যে ব্যক্তি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকে তাকে ভোক্তা বলা হয়। ভোক্তা হচ্ছেন এক বা একাধিক মানুষ, যারা কোন পন্যের চূড়ান্ত ভোগ সম্পন্ন করে। ভোক্তারা একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার - ভোক্তাদের এ চারটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেন যা পরবর্তীতে ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়।
বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ও ভোক্তাদের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার কর্মী মালয়েশিয়ার আনোয়ার ফজল এ দিবস পালনে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৩ সালের ১৫ মার্চ তিনি ভোক্তা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ভোক্তাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতার উদ্দেশ্য বৈশ্বিকভাবে উৎযাপনের আহ্বান জানান।
১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই কনজুমার্স ইন্টারন্যাশনাল এ সকল অধিকারকে সনদে অন্তর্ভুক্ত করে। কেনেডি’র ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে উদ্যাপন করে আসছে।
বর্তমান কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন এখন অনেক কিছুই ডিজিটাল বা অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে এবং প্রতিদিন এ খাতে ভোক্তাদের ঝুঁকির নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভোক্তারা বরাবরই পণ্য ও সেবা উভয় ক্ষেত্রেই অনায্যতার শিকার হচ্ছে। ভোক্তারা অসচেতন, অসংগঠিত, স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী ভোক্তা সংগঠনের দুর্বলতা ও আইনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার না থাকার কারণে প্রবঞ্চনার হার প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
দেশে বাড়তি দরে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে ক্রেতারা। সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে অনেক ভোক্তার। অভিযোগ রয়েছে, মজুদ করে দাম বৃদ্ধির পায়তারায় ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। নিম্নমানের পণ্য দেয়া, মজুত করে দাম বৃদ্ধির পয়তারায় ব্যস্ত এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিটি পণ্যের দাম উর্দ্ধমূখী। এতে ক্ষোভ বাড়ছে, ক্রেতা সাধারণ হতাশ হচ্ছেন। ক্ষোভ আছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না ভোক্তা।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসার দিন দিন বাড়ছে। অনেক উদ্যোক্তা অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে অভাবনীয় সফলতা পাচ্ছেন। অনলাইন ব্যবসা দেশের প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বড় কোন প্রস্তুতি বা পুঁজি ছাড়াই প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও উদ্যোক্তা হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখছে। অথচ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারনে অনলাইন থেকে পন্য ক্রয় করতে আগ্রহ হারাচ্ছে, ক্রেতা সাধারন প্রতারিত হচ্ছেন।প্রতারকেরা যেসব অপকর্ম করে থাকেন তা হলো, দামি পণ্যের অর্ডার নিয়ে কম দামি পণ্য সরবরাহ করা, ত্রুটিপূর্ণ-নিম্নমানের পণ্য দেওয়া, গ্রাহকের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত আচরণ না করা, মিথ্যা, বাহারি ও নামীদামি তারকা, মডেল ও খেলোয়াড়দের ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়া ও পণ্যের মজুত না থাকলেও অর্ডার নেওয়ার মতো প্রতারণা করে যাচ্ছে এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান।
প্রতারণার আরেক ধাপ হলো, দুর্বোধ্য ও ভোক্তা স্বার্থবিরোধী শর্ত জুড়ে দেওয়া। শর্তগুলো এত ছোট অক্ষরে ও কঠিন ভাষায় লেখা থাকে, যা অনেকেরই বুঝতে কষ্ট হয়। আর এসব শর্ত দিয়ে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ভোক্তাদের বোকা বানায়। আর অধিকাংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ ডেলিভারি পয়েন্ট ভোক্তাবান্ধব নয়। সেখানে গেলে ক্রেতাকে অনেক ক্ষেত্রে নাজেহাল হতে হয়।
দেশের বাজার ব্যবস্থায় ভোক্তা অধিকার বিরোধী অপকর্মগুলো প্রতারকেরা সুকৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা থাকলেও নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা, ভেজালমিশ্রিত পণ্য বিক্রয় করা, খাদ্যপণ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যহানিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ ঘটানো, পরিমাণ ও পরিমাপগত কারচুপি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ বা নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্য বিক্রয় করা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পণ্য বা সেবার মূল্যমানের তালিকা প্রকাশ না করা এসব ভোক্তা অধিকার বিরোধী অপচেষ্টা প্রতিহত করার জন্যই বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে।
বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১০ সালে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধ এবং ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ নকল ও ভেজাল রোধে অধিদফতর নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। ভোক্তাগণ কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। অধিদপ্তর তদন্ত করে যদি অভিযোগ প্রমাণিত করতে পারে সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ করা এবং জরিমানার ২৫ শতাংশ ভোক্তাকে প্রদান করা হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একটি আধা-বিচারিক সরকারি সংস্থা যা পণ্য ও পরিষেবার উপর ভোক্তাদের অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি এবং ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করার অভিলক্ষ্যে কাজ করে থাকে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৪৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের অনলাইন কেনাকাটা যেন স্বচ্ছ হয়, কোনো ধরনের প্রতারণা বা অনিয়ম না হয় এবং গ্রাহকরা যেন তাদের ন্যায্য অধিকার পান, সে বিষয়ে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রত্যেকেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বশীল হতে হবে। ভোক্তা যাতে কারো ব্যক্তিস্বার্থ বা লোভ-লালসার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে ব্যবসায়ী, জনগণসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ই-কমার্সের প্রতারণা বন্ধে নজরদারি জোরদার এবং ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতনতা প্রয়োজন।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট