

শুক্রবার ● ৭ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মব জাস্টিস প্রতিরোধে জনগণকেই ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে
মব জাস্টিস প্রতিরোধে জনগণকেই ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হচ্ছে মব জাস্টিস। মব অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। মব জাস্টিস অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে মব জাস্টিস বলা হয়ে থাকে।
মব জাস্টিস এখন নতুন এক আতঙ্কের নাম। সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা এক ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে সর্বত্র। এ মব জাস্টিসে কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, কারও বাসায় ঢুকে লুটপাট করা হচ্ছে, কোনো থানা ঘেরাও করা হচ্ছে, কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে পদত্যাগে। সব মিলিয়ে এক নতুন আতঙ্কের নাম এখন মব জাস্টিস।
বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন ঘটনা নতুন সংবাদের জন্ম দিচ্ছে। অনেক ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু না তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আর এসবের ফলাফল সুদূরপ্রসারী। সাম্প্রতিক সময়ে এই মব জাস্টিসের নামে কাউকে গণপিটুনি, বাড়িতে ঢুকে লুটপাট, ধর্ষণ করা, কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা, কাউকে জুতার মালা পরিয়ে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে। দলবদ্ধ হয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার ঘটনাও বেড়েছে। কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সর্বত্র এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
দেশে বিপ্লব বা বড় কোনো পরিবর্তনের পর এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর সৃষ্ট এ পরিস্থিতি। বিগত সরকারের স্বৈরাচারি শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল, তার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে কিছু বেআইনি কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর মানুষের মনের সেই ক্ষোভ দিনে দিনে কমে আসবে, এটাই সবাই আশা করেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অভ্যুত্থানের ৭ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও মব জাস্টিস বন্ধ হচ্ছে না, বরং দিন দিন তা প্রকট আকার ধারণ করছে। জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে ।
মব জাস্টিসের নামে ধর্ষণ, গণপিটুনি, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটসহ একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে দুষ্কৃতিকারী ছাড়াও সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। মব সৃস্টি করে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কিছু মানুষ সংঘটিত হয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে মবের ঘটনা সংঘটিত করছে, এতে বাড়ছে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ। ডাকাত-ছিনতাইকারীর পাশাপাশি অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ঘায়েল হচ্ছে এই মব জাস্টিসে। ফলে নাগরিক সমাজে উদ্বেগ বাড়ছে।
হুজুগে জনতা মব জাস্টিস বাংলাদেশে নতুন নয়। মব সবসময়ই অনেক বেশি আবেগী, যুক্তিহীন ও দায়িত্বহীন। রাস্তাঘাটে পকেটমার বা ডাকাত বলে একজনকে সবাই মিলে মারছে। মব-মারের জটলায় লোকজন হুড়াহুড়ি করে এসে সবার দেখাদেখি লাথি মারছে। লোকটার কি অপরাধ কেউ জানতে চাচ্ছে না। যে যার মতন পিটাচ্ছে। কী নিষ্ঠুরতা! কেউ ভাবছে না, লোকটা নির্দোষও হতে পারেন। জনতা উত্তেজিত হয়ে অপরাধী বলে মারধোর করছে। মবের হাতে দুচার ঘা খাওয়া তেমন কোন সমস্যাই না বলতে পারেন, কিন্তু আরও কুড়ি পঁচিশজন দু চার ঘা করে বসিয়ে দিলে তখন মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক। যদি এতে অপরাধী ভাবা ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তা মব লিঞ্চিং হবে যা অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যা।
মব জাস্টিস উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। আসামিদের যখন আদালতে আনা হয়, তখন জনতা ও আইনজীবীরা তার ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। যখন আদালতে তোলা হয়, তখন লোকজন ও আইনজীবীরা চড়-থাপ্পড় মারেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীকে মারধর করে আদালত থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। আসামিরা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে এবং আদালতের আঙ্গিনায়, তখন তাদের বা তাদের আইনজীবীর ওপর হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ। যে সব লোক এর সঙ্গে জড়িত, অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বস্তুত এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা দৃশ্যমান নয়। সরকারকে এক ধরনের নির্বিকার বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও মব জাস্টিসের কোনো কোনো ঘটনায় সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। এরপরও দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সর্বত্রই কেমন যেন একটা গাছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশে কেউ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে বাস্তবেই কঠোরতার প্রমাণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চায় দেশবাসী। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বিগত কয়েক মাসে মব জাস্টিসের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ক্রমাগত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। মব জাস্টিসে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধে সাধারন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট